বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত ২৬ সেপ্টেম্বর আজ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত ২৬ সেপ্টেম্বর আজ

বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ ফেব্রুয়ারি, ৭ ও ২৬ মার্চ, ১০ জানুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বরের মতো স্মরণীয় দিনগুলোকে জাতি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে থাকে। পাশপাশি গণহত্যার ২৫ মার্চ, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ১৫ আগস্ট, দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৭ আগস্ট, মহান জাতীয় সংসদে কালো একটি আইনের দিন ৯ জুলাই, জাতীয় চার নেতাকে হত্যার ৩ নভেম্বরসহ বেশ কিছু দিবস বাংলাদেশের জনগণ চাইলেও ভুলতে পারে না কোনোভাবে। এসব কলঙ্কিত দিনগুলোর আরেকটি কলঙ্কিত দিন হলো ২৬ সেপ্টেম্বর।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর  ১৯৭৫ সালের এই দিনে খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার সেই কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছিল।

ইনডেমনিটি কী

ইনডেমনিটি হল কোন বিচার কার্যকে বাধাদান সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বা আইন। ইনডেমনিটির সংজ্ঞায় বলা যায়, কোন অভিযোগ বা অভ্যুত্থানের ক্ষয়ক্ষতি আদালতের বাইরে রাখার জন্য আইনসভা যে বিল পাস করে তাকেই ইনডেমনিটি বিল বলে। মানবতা বিরোধী এক ধরনের কালো আইন। আর  মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই ব্যতিক্রমধর্মী আইন জারি করেছিল খন্দকার মোশতাক।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ৫০নং অধ্যাদেশ ছিল ইনডেমনিটি। শিরোনাম ছিল রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নম্বর ৫০। খন্দকার মোশতাকের পাশাপাশি তাতে স্বাক্ষর করেন সে সময়ের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবও।

এই অবৈধ ও কালো অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের দায় থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। পৃথিবীর ইতিহাসের বর্বরতম আইনগুলো অন্যতম একটি আইন হল এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ইহা হল পৃথিবীর সভ্যতা ও মানবতার ইতিহাসে একটি ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর কালো আইন।

কী ছিল ইনডেমনিটি অধ্যাদেশে?

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটিতে দু’টি অংশ আছে।  এর প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন এই ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টসহ কোন আদালতে মামলা, কোন অভিযোগ দায়ের বা কোন আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।’

দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায় মুক্তি দেওয়া হল। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোন আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা আইনী প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।’

বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘মীরজাফর’ খন্দকার মোশতাকের জারি করা এই  অধ্যাদেশটি নিয়ে পরবর্তীতে যা ঘটল তা বাংলাদেশে তথা বিশ্বের ইতিহাসে আরও নজিরবিহীন বলে মনে করে থাকেন সচেতন নাগরিক ও বিশ্লেষকরা।

খন্দকার মোশতাককে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের মাধ্যমে হ্যাঁ-না ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হয়ে এই মানবতা বিরোধী অধ্যাদেশটি বাতিল ও খুনীদের বিচার না করে বরং সাংবিধানিকভাবে তাদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেন।

১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই জাতীয় সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিএনপি এই কলঙ্কিত অধ্যাদেশকে বিল হিসেবে পাস করিয়ে নেয়। এর ফলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর সেদিন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই কালো আইনটি। এর ফলে  সপরিবারে বঙ্গবন্ধুহত্যাসহ  জাতীয় চার নেতা হত্যা পর্যন্ত বিচার থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়! দায় মুক্তির পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি দিয়েও খুনিদের পুরস্কৃত করেন জিয়াউর রহমান।

ইনডেমনিটি সংবিধানে অন্তর্ভূক্তি করার ফলে ওই বঙ্গবন্ধুর খুনিরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন। প্রকাশ্যে  তারা নিজেদেরকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিপ্লবের মহানায়ক বলে দাবি করে মিডিয়ায় প্রচার করতে থাকেন।

শুধু জিয়াউর রহমান নয়, পরবর্তীতে বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ,  খালেদা জিয়ার শাসনামলেও ওই কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল করাতো হয়নি, বরং খুনীদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। খুনীদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করা হয়েছে, জাতীয় সংসদের সদস্য বানানো হয়েছে, পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা বানানো হয়েছে-এমনকি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার সুযোগও দেওয়া হয়েছিল।

পরবর্তীতে গণআন্দোলনে এরশাদ সরকারের পতন হলে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তখন সংসদের বিরোধী দলে। বিএনপির ওই শাসনামলে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিলের জন্য জাতীয় সংসদে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছিল। তবে ‘অধ্যাদেশটিকে একটি জটিল ও অপ্রত্যাহারযোগ্য আইন ‘ বলে সংসদে উত্থাপিত আওয়ামী লীগের বিলটিকে বাতিল করে দেন ওই সময়ের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী বিলটি মির্জা গোলাম হাফিজ।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ওই সময় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিলের আইনগত বিভিন্ন দিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখার জন্য তৎকালীন আইন সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সিদ্ধান্ত নেয় যে, অধ্যাদেশটি বাতিলের জন্য সংবিধান সংশোধনের কোন প্রয়োজন নেই। সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েই তা সংসদে বাতিল করা সম্ভব।

পরবর্তীতে তৎকালীন আইনমন্ত্রী এডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল এ্যাক্ট-১৯৯৬’ নামে একটি বিল ১০ নভেম্বর মহান সংসদে উত্থাপিত হওয়ার পর  ১২ নভেম্বর বিলটি পাস হয় এবং ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মাধ্যমে তা আইনে পরিণত হয়। আর এই আইন পাসের মাধ্যমে দীর্ঘ ২১ বৎসর পর বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়।

এর পরের ইতিহাস সবার জানা। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর দন্ডবিধির ১২০বি/৩০২/৩৪ এবং ২০১ ধারায় বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। ঢাকার দায়রা জজ আদালতে খুনীদের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ২০ আসামীর মধ্যে ৫ জনকে খালাস দিয়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। পরে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা আপিল করলে আরও ৩ জনকে খালাস দিয়ে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন উচ্চ আদালত।

Link copied!