মে ২৫, ২০২৩, ০৭:৩০ পিএম
প্রয়াত চিত্রনায়ক, বাংলা চলচ্চিত্রের মিয়াভাই, সংসদ সদস্য ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সদ্য প্রয়াত আকবর হোসেন পাঠান ফারুকের ব্যাংকঋণের মূল পরিমাণ (প্রিন্সিপাল আ্যামাউন্ট) ৩৬ কোটি টাকার একটু বেশি। তবে, সুদসহ ঋণদাতা সোনালী ব্যাংকের দাবি ক্রমশ বাড়ছে। অর্থঋণ আদালতের রায় পেয়ে দুই বছর আগে সোনালী ব্যাংকের দাবি প্রথমে ছিলো ৮৮ কোটি টাকা। এরপর এটি বেড়ে হয়েছে ১০১ কোটি। চলতি মে মাসের হিসেব যোগ করলে ওই দাবি ১২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের অনুসন্ধানে জানা গেছে, একজন স্বপ্নবান মানুষ ছিলেন রূপালি পর্দার বিপুল জনপ্রিয় এই নায়ক। রূপালি পর্দায় সফল হলেও ব্যবসায় নেমে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন ঢালিউডের মিয়াভাই খ্যাত এই নায়ক। এই ব্যর্থতার পেছনে তাঁর ঋণদাতা ব্যাংক অনেকাংশে দায়ী। তাঁকে যথাসময়ে ঋণ না দিয়ে নানা অজুহাতে তাঁর বিনিয়োগ বিঘ্নিত করেছে ব্যাংক। ফলে তিনি দিনকে দিন ঋণের ফাঁদে পড়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি।
এদিকে তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে একটি মহল মিথ্যা সংবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয় যে, চিত্রনায়কের নামে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকঋণ রয়েছে। এই ঋণ এখন খেলাপি। এ খবরে বিস্মিত হয় তাঁর স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয় স্বজন ও কারখানার কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
জনপ্রিয় এ চিত্রনায়ক ফারুক মরেও অমর হয়ে আছেন লাখো ভক্তের হৃদয়ে। তাই তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ও গানে তাকে খুঁজে ফিরছেন এসব ভক্তকূলের অনেকেই। তারাও জানতে চান বর্ষিয়ান অভিনেতা ফারুকের ব্যাংক ঋণ আসলে কতো। কীভাবে তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপী হলেন!
নায়ক ফারুকের আলোচিত ওই ঋণের বিষয়ে দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ সপ্তাহব্যাপী একটি অনুসন্ধান চালিয়েছে। এ সময় তথ্য সংগ্রহ ও কথা বলা হয় প্রয়াত ফারুকের কোম্পানি ম্যানেজার ও সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখায়। খোঁজ নেওয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকেও।
এসব অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যাংকের হিসেবে ফারুক নিটিং এর অনুকূলে সর্বেসর্বা মূল ঋণ বা প্রিন্সিপাল আ্যামাউন্ট দাঁড়িয়েছে ৩৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। এরমধ্যে বিভিন্ন ধাপে পাওয়া প্রকল্প ঋণ ৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা, বিএমআরই ১২ কোটি ২ লাখ টাকা ও সিসি বা ১২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এখানে ব্যাংকের ফাইলে বর্ণিত হিসেবে খাতভিত্তিক ও মোট অংকের মধ্যে গরমিল পাওয়া যায়। কারণ মোট অংক দাঁড়ায় ৩৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ৩৬ কোটি ৮৭ লাখ নয়।
তবে ২০২৩ সালে এসে ব্যাংক এখন দাবি করছে ১০১ কোটি টাকা। এরমধ্যে আছে প্রিন্সিপাল আ্যামাউন্ট, সুদ, মালার খরচ ও অর্থঋণ আদালতের রায় পাবার পর জারি করা মামলার হিসেবে বাড়তি সুদ ও ব্যাংকের অন্যান্য খরচ। ২০১৯ এ ব্যাংকের দাবিকৃত টাকার পরিমান ছিলো ৮৮ কোটি টাকা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, একজন শিল্পোদ্যোক্তা কীভাবে ব্যাংকের অসহযোগীতার কারণে ব্যর্থ প্রমাণিত হন। কীভাবে একজন শিল্পোদ্যোক্তার স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। এ কাহিনী যেনো একটা মানবাধিকার লঙ্ঘনেরই চিরায়ত চিত্র।
জানা যায়, দেশপ্রেমী, শিল্পীমনা ফারুক গাজীপুরের মৌচাক এলাকায় তাঁর নিজের আয়ের টাকায় কেনা জমির উপর একটি কম্পোজিট নিটিং, ডায়িং, ম্যানুফ্যাকচারিং ও ফিনিশিং কারখানা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে ২০০১ সালে সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিসে ঋণসহায়তার আবেদন করেছিলেন।
২০০৩ সালে সেই ঋণ আবেদন অনুমোদন করে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন কর্মকর্তারা ফারুক নিটিং এর অনুকূলে মাত্র দেড় কোটি টাকা ছাড় করে। এরপর তাঁকে নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করে বছরের পর বছর পার করে দেয়। শিল্পোদ্যাক্তা হতে গিয়ে ফারুক হতাশ হয়ে পড়েন।
এদিকে ব্যাংকের পরামর্শে তিনি তাঁর নিজের অর্জিত আয়ের পুরোটা ব্যয় করে অবকাঠামো গড়ে তুলেন। ব্যাংকের শর্ত পূরণে তিনি আবারো ৪৫ হাজার বর্গফুটের ৫ তলা ভবনের অবকাঠামো পূণনির্মান করেন। এতে করে প্রয়াত ফারুকের প্রায় সব জমানো টাকা শেষ হয়ে যায়। এরমধ্যে এক এগারো পরবর্তী পরিস্থিতি তাঁকে আরো ব্যাকুল করে তোলে। কিন্ত ব্যাংক প্রতিশ্রুত ও অনুমোদিত অর্থ ফারুককে দেয়নি।
এরপরও হাল ছাড়েননি রূপালি পর্দার সফল এই নায়ক। ২০০৮ এর সংসদ নির্বাচনের পর আবারো তিনি ব্যাংকে যোগাযোগ করেন। অতঃপর, বিএমআরই বা ব্যালেন্সিং, আধুনিকায়ন, বিস্তার ও প্রতিস্থাপন ব্যয় বাবদ ব্যাংক তাঁকে ২০০৯ সালে ২ কোটি ৩ লাখ ও ২০১০ সালে ১২ কোটি ২ লাখ টাকা বিতরন করে।
২০০১ থেকে ২০১০, এ দীর্ঘ সময়ে আপাতত, কারখানার নির্মাণ ও মূলধনী যন্ত্রপাতি স্থাপন সম্পন্ন হলো। এবার দরকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল। কিন্ত আবারো ব্যাংক কালক্ষেপণ শুরু করলে ফারুক তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রয়াত এ এম এ মুহিতের সহায়তায় ১২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বা সিসি পান।
তখন প্রয়াত অর্থমন্ত্রী মুহিত কোনও এক প্রসঙ্গে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, `ব্যাংকের ঋণদান প্রক্রিয়াতেই একজন শিল্পোদ্যোক্তা ঋণখেলাপী হয়ে পড়েন। এসব দেখা দরকার।`
ওই অবস্থায় ফারুকের নিটিং কারখানা চালু হয় কিন্তু ব্যবস্থাপনাসহ নানা বিষয়ে অদক্ষতা থাকায় লাভের মুখ দেখেনি। তারপরও শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও কাঁচামাল ক্রয় করে উৎপাদন অব্যাহত থাকে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করতে। এ সময় তিনি ঋণ খেলাপী হয়ে পড়লে এককালীন ৪ কোটি টাকা জমা দিয়ে ঋণ পূণ:তফশীল করে নেওয়া হয়। আপাতত নির্বাচনে টিকে থাকার জটিলতার নিরসন হয়।
ফারুক নিটিং এর ম্যানেজার মামুন জানান, এরপর আরও ৬ কোটির মতো টাকা বিভিন্ন সময়ে ব্যাংকে পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্ত কারখানাসহ ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ হয় ২০২১ সালে চিকিৎসার জন্য ফারুক সিঙ্গাপুর যাওয়ার পর থেকে।
এতোদিন এ ঋণ নিয়ে কোনও আলোচনা হয়নি।
গত ১৫ মে সিঙ্গাপুর থেকে নায়ক ফারুকের মৃত্যু সংবাদ এলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে যে তাঁর ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপী আছে। অনেকে সত্য তথ্য না জেনে সেসব পোস্ট শেয়ার করতে থাকেন। এ ঘটনায় ফারুকের পরিবারের সদস্যরাও মর্মাহত হন। তার পরিবারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়, প্রয়াত ফারুককে নিয়ে যেনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্য তুলে ধরা হয়।
যে ব্যাংকে প্রয়াত ফারুকের ঋণ, সে ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এ নিয়ে কথা বলতে চান না। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান দুজনেই বিদেশে অবস্থান করায় তাঁদের মন্তব্য নেওয়ার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে কর্মকর্তারা বলেছেন, ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট জামানত আছে যা থেকে তারা ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে নিতে পারবেন। প্রয়াত ফারুকের পরিবারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত জামানত দেওয়া আছে।
ফারুক নিটিং এর ম্যানেজার মামুন জানান, গাজীপুরের মৌচাক এলাকায় যে পরিমান জমির উপর কারখানার স্থাপনাসহ ব্যাংক কে যে মর্টগেজ দেওয়া হয়েছে তার চেয়ে পাঁচগুণ জমি ওখানে আছে। জমি ও কারখানা বিক্রি করে ব্যাংকঋণ শোধ করে দেওয়া হবে। কারখানায় ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত ৩৬ কোটি টাকার অনেক বেশি ফারুক নিজের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগ করেছেন।
সোনালী ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে বলা হয়, খুব শীঘ্রই ব্যাংকের একটি প্রতিনিধিদল কারখানা পরিদর্শনে যাবে।