বড় নির্বাচনী জয় দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে সেই বিপুল জনপ্রিয়তা ধসে গিয়ে বড় ধরনের লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করতে হলো তাঁকে। পদত্যাগী এই নেতা হলেন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কনজার্ভেটিভ পার্টির প্রধান আলেক্সান্ডার বরিস দ্য ফেফেল যাকে বিশ্ববাসী চেনেন বরিস জনসন নামেই।
মাত্র তিন বছরেরও কম সময় আগের কথা। ১৯৮৭ সালের নির্বাচনের পর কনজার্ভেটিভ দলকে সবচেয়ে বড় নির্বাচনী বিজয় এনে দিয়ে আলোচনায় আসেন জনসন। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে এত জনপ্রিয় একজন প্রধানমন্ত্রী তাঁর এমপিদের সমর্থন হারিয়েছেন এবং পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে পাঁচটি কারণ বেরিয়ে এসেছে।
কারণগুলো হলো:
এক. ক্রিস পিনচারের যৌন অসদাচরণ
দুই. করোনাকালে পার্টিগেট কেলেঙ্কারি
তিন. জীবনমানের খরচ এবং ট্যাক্স বৃদ্ধি
চার. ওয়েন প্যাটারসনকে নিয়ে ক্ষোভ
পাঁচ. দৃষ্টিভঙ্গি ও আইডিয়ার অভাব
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিবিসির সাংবাদিক ওয়েন আমোস এই পাঁচটি কারণ উদঘাটন করেছেন। আমোস লিখেছেন, ২৯শে জুন বুধবার ওই সময়কার এমপি ক্রিস পিনচার লন্ডনে একটি প্রাইভেট সদস্যদের ক্লাবে যোগ দেন। তিনি ওই সময় কনজার্ভেটিভ পার্টির ডেপুটি চিপ হুইপ ছিলেন। নিজের মুখেই তিনি বলেছেন, সেখানে তিনি খুব বেশি মদ পান করেছিলেন এবং তা নিয়ে নিজেই বিব্রত। ওই ক্লাবে দু’জন পুরুষকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ঘটনার পরই অভিযোগের ডালি যেন খুলে যায়। আগের বছরগুলোতে তিনি যেসব অপরাধ করেছেন সেগুলোও সামনে চলে আসতে থাকে।
আমোস আরও লিখেছেন, বরিসের অপরাধগুলো একটির সাথে আরেকটি যুক্ত হতে হতে এতটাই ভারি হয়ে ওঠে যে, তাতে প্রধানমন্ত্রীর বিদায়ের ঘন্টা বাজিয়ে দেয়।
প্রথমত ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বলা হয়, ফেব্রুয়ারিতে ডেপুটি চিপ হুইপ হিসেবে পিনচারকে নিয়োগ দেন বরিস জনসন। এর আগে তিনি তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট বিশেষ কোনো অভিযোগ সম্পর্কে জানতেন না। কিন্তু দেখা যায়, ওই বিবৃতি পুরোপুরি সত্য নয়। ফলে মন্ত্রীরা এটাকে ইস্যু করে ফেলেন। কারণ, এতে দলের ক্ষতি হচ্ছিল। সরকারেরও ক্ষতি হচ্ছিল।
দেখা যায় ৪ঠা জুলাই বিবিসি রিপোর্ট করে যে, পিনচারের বিরুদ্ধে একটি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন জনসন। পরের দিন সাবেক একজন সরকারি কর্মকর্তা লর্ড ম্যাকডোনাল্ড বলেন, এই অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছিল। পরে বরিস জনসন কবুল করে নেন যে, তাঁকে ২০১৯ সালে বলা হয়েছিল বিষয়টি। এরপরই তিনি পিনচারকে দলের ডেপুটি চিপ হুইপ নিয়োগ করার জন্য ক্ষমা চান।
এর আগে ঘটে যায় পার্টিগেট কেলেঙ্কারি। এ বছরের এপ্রিলে করোনাভাইরাস মহামারিকালে লকডাউন বিধি ভঙ্গ করে গোপনে পার্টি করার জন্য জরিমানা করা হয় প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে। ২০২০ সালের জুনে তাঁর জন্মদিনের এক পার্টিতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। এ ছাড়া প্রথম লকডাউনকালে ডাউনিং স্ট্রিটের গার্ডেনে পার্টিতে যোগ দেওয়ার জন্য ক্ষমা চান তিনি। আরও বিস্তৃতভাবে বলা যায়, ডাউনিং স্ট্রিট ও হোয়াইটহলে লকডাউন বিধি ভঙ্গ করার কারণে ৮৩ জন ব্যক্তিকে ১২৬টি জরিমানা ইস্যু করে। সরকারের সিনিয়র কর্মকর্তা সু গ্রে সামাজিক ইভেন্টের ধারাবাহিক বর্ণনা দেন। যা লকডাউন বিধি ভঙ্গ করেছে।
ওই কর্মকর্তা আরও লিখেছেন, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব- রাজনৈতিক ও সরকারি পর্যায়ে, যারা আছেন তাঁদেরকে অবশ্যই এই সংস্কৃতির দায় বহন করতে হবে। কিন্তু গত ডিসেম্বরে হাউজ অব কমন্সে প্রধানমন্ত্রী জনসন বলেন, ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে সব নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পার্লামেন্টকে বিভ্রান্ত করেছেন কিনা তা এখন তদন্ত করছে হাউজ অব কমন্সের একটি কমিটি।
এ বছরে এসে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে দ্রুতগতিতে। বর্তমানে তা শতকরা ৯.১ ভাগ। এরমধ্যে বেশির ভাগ কারণ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। উদাহরণ হিসেবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বভাবতই তাতে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন জ্বালানিখাতে প্রতি লিটারের জন্য ৫ পেন্স করে শুল্কহার কমিয়েছে।
এপ্রিলে এসে ট্যাক্স বৃদ্ধি করা হয়। ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স বেড়ে যায় প্রতি পাউন্ডে ১.২৫ পেন্স। সরকার বলে যে, এই ট্যাক্স বৃদ্ধির অর্থ খরচ করা হবে স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবায়। তবে বছরে কেউ ৩৪ হাজার পাউন্ডের বেশি আয় করলে তাকে আরও বেশি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এ অবস্থায় বিরোধী লেবার দলের প্রধান স্যার কিয়ের স্টরমার বলেন, কয়েক দশকের মধ্যে এখন জীবনমানের খবর সবচেয়ে বাজে অবস্থায়। কর্মজীবী মানুষের ট্যাক্স বৃদ্ধিকে বেছে নিয়েছে সরকার।
২০২১ সালের কথা। হাউজ অব কমন্সের একটি কমিটি তখনকার কনজার্ভেটিভ পার্টির এমপি ওয়েন প্যাটারসনকে ৩০ দিনের জন্য সাময়িক বরখাস্তের সুপারিশ করে।
কমিটির অভিযোগ, তিনি লবিং আইন লঙ্ঘন করেছেন। যেসব কোম্পানি তাঁকে অর্থ দিয়েছে, তিনি তাঁদেরকে সুবিধা দিয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের নেতৃত্বে কনজার্ভেটিভরা ওই স্থগিতাদেশকে থমকে দেওয়ার জন্য ভোট করে। এরপর নতুন একটি কমিটি গঠন করে। তাঁদের কাজ হলো, কীভাবে আগের কমিটি তদন্ত করেছে তা অনুসন্ধান করা। কিন্তু প্রচণ্ড উত্তেজনার পর ওয়েন পিটারসন পদত্যাগ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেন, এ ঘটনায় তাঁর হাত ছিল।
গেট ব্রেক্সিট ডান— এই নীতিতে পরিষ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন বরিস জনসন। কিন্তু তখন থেকে তাঁর সমালোচকেরা বলছেন, ডাউনিং স্টিটের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আইডিয়ায় ঘাটতি আছে। বরিস জনসনের সাবেক উপদেষ্টা ডমিনিক কামিংস হয়ে ওঠেন প্রধান সমালোচক। বার বার তিনি জনসনের বিরুদ্ধে সমালোচনার তীর বর্ষণ করতে থাকেন। জুনে কনজার্ভেটিভ দলের এমপি ও সাবেক মন্ত্রী জেরেমি হান্ট সমালোচনা করেন জনসনের। তিনি বলেন, তাঁর সততা, যোগ্যতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি আছে। জেরেমি হান্ট আস্থাভোটের আগে বক্তব্যে এসব বলেছিলেন। যদিও সে বার অল্পের জন্য পার পেয়েছিলেন জনসন।