বিচ্ছিন্নতাই কোরিয়ার ইতিহাস। উনবিংশ শতকের আগ পর্যন্ত তেমন কিছুই জানা যায় না কোরিয়া সম্পর্কে। আর এ জন্যই একে বলা হয় হারমিট কিংডম। ১৮৮০’র দশকে এই নাম দেওয়া হয় কোরিয়ার। তবে, আজ অব্দি হারমিট কিংডম নামেই পরিচিতি কোরিয়া।
বহিঃশক্তির প্রভাব এবং অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে উনিশ শতকে এসে ভেঙ্গে যেতে শুরু করে হাজার বছরের পুরনো কোরিয়ার রাজতন্ত্র। আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় কোরিয় সরকারের ওপর চাপ বাড়ায় জাপান। কোরিয়ার প্রতিরক্ষায় চায়না এগিয়ে আসলে ১৮৯৪ সালে শুরু হয় সিনো-জাপান যুদ্ধ।
এতে জাপান বিজয়ী হয়। দীর্ঘ সময় ধরে কোরিয়ায় থেকে যায় জাপানী সেনারা। কোরিয় নাগরিকদের ভয় দেখাতে পুরুষদের বিক্রি করা হয় দাস হিসেবে, নারীদের বানানো হয় যৌন কর্মী।
১৮৯৬ সালে রাজ প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে যান রাজা গজং। আশ্রয় নেন সিউলে অবস্থিত রাশিয়া দূতাবাসে। রাশিয়ার আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় গজং এর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে রাশিয়ার জার সরকার।
আধিপত্য পাকাপোক্ত করতে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথ নির্মাণ করে রাশিয়ার সরকার; যা কোরিয়া এবং চায়নায় প্রভাব ধরে রাখতে হুমকি হিসেবে দেখে জাপান। দুদেশের উদ্বেগ বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। ১৯০৪ সালে শুরু হয় যুদ্ধ। কোন ফলাফল ছাড়াই এক বছর পর থামে এই সংঘাত।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত কোরিয়া শাসনের দায়িত্ব পায় জাপান। এর ফলে পরের কয়েক দশক কোরিয় নাগরিকদের ওপর ভয়াবহ নৃশংসতা চালানোর সুযোগ পায় জাপান।
এর মধ্যেই বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল। সামরিক শক্তিকে ঢেলে সাজানো হয়। আরও বেশি দাসত্বে বন্দী হয় কোরিয়ানরা। এমনকি জাপানের শিন্টো দেবতাকে পূজা করতেও বাধ্য করা হয়।
তবে, বিনা বাধায় নিজেদেরকে বহিঃশক্তির কাছে সোপর্দ করেনি কোরিয় নাগরিকরা। জাপানি দখলদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গেরিলা লড়াই শুরু করে প্রায় দুই লাখ কোরিয় সৈনিক।
এর মধ্যে অনেকেই ছিলেন রাশিয়ার কমিউনিস্ট ঘরানার। তাদেরই একজন কিম সং জু। কোরিয়ায় জন্ম নিলেও, চায়নায় বেড়ে ওঠেন কিম সং জু।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ ভাগে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য সোভিয়েত সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ থেকেই শুরু হয় উত্তর কোরিয়ার ইতিহাস। যুদ্ধ শেষে মিত্রদের মধ্যে শুরু হয় ভাগ-বাটোয়ারা।
দ্বিখণ্ডিত হয় জার্মানি। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক তরিকা গ্রহণ করে পশ্চিম জার্মানি। রাশিয়াপন্থী সমাজতান্ত্রিক আদর্শে প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ব জার্মানি।
একই বাটোয়ারা নীতি অবলম্বন করা হয় কোরিয়ায়। ১৯৪৫ সালে ৩৮ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা বরাবর ভাগ হয়ে যায় কোরিয়া। উত্তর অংশের দখল নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন আর দক্ষিণ অংশের যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৪৭ সালে কোরিয় উপদ্বীপে গণতন্ত্র প্রতষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে ভোটের উদ্যোগ নেয় জাতিসংঘ।
তবে, এতে অস্বীকৃতি জানায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে রাশিয়ার আধিপত্য হুমকির মুখে পড়তে পারে বলেই নির্বাচনের ব্যাপারে অনীহা ছিল দেশটির। তাই, যুক্তরাষ্ট্রের দখলে থাকা দক্ষিণ অংশেই কেবল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয় লাল করেন সিংম্যান ড়ি। তবে, এসময় সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে হাঁটে উত্তর কোরিয়া। দৃশ্যপটে উপস্থিত হন জাপান-বিরোধী কমিউনিস্ট গেরিলা নেতা কিম সং জু।
কিম ইল সাং নামে নতুন করে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। যার অর্থ ’কিম হলেন সূর্য’। জাপান-বিরোধীতা এবং কমিউনিস্ট আদর্শের কারণে কিমকে দলের ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করে রাশিয়া।
চায়নায় বেড়ে ওঠা কিম ইল সাং সামান্যই বলতে পারতেন কোরিয় ভাষা। তাই, কোরিয়ার স্থানীয় ভাষায় বক্তব্য অনুবাদ করে দিতো সোভিয়েত ইউনিয়ন। জাতীয় বীর হিসেবে আস্তে-ধীরে কিমকে পরিচিত করানো শুরু করে সোভিয়েত।
১৯৪৮ সালে পিপলস আর্মি প্রতিষ্ঠা করেন কিম ইল সাং। শীর্ষ পদে আসীন হন তার গেরিলা কমরেডরা। এছাড়াও উত্তর কোরিয়ার সাহিত্য ও কলা ফেডারেশন গঠন করেন কিম। নাগরিকদের মনস্তত্ত্ব অনুকূলে আনতে সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ওপর জোর দেন।
গড়ে তোলেন ব্যক্তিকেন্দ্রীক রাষ্ট্র। উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের কাছে নিজেকে ঈশ্বরসমতূল্য করে গড়ে তুলতে কাজে লাগান শিল্প ও মিডিয়া।
সিংম্যান ড়ি নির্বাচনে জয় লাভ করার তিন মাসের মাথায় ডেমোক্র্যাটিক পিপল’স রিপাবলিক অব কোরিয়া ঘোষণা দেন কিম ইল সাং যার সর্বেসর্বা তিনি নিজেই।
এসময় সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিন এবং চীনের মাও সেতুং এর সমর্থনও পান তিনি। ১৯৫০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় হামলা চালান কিম।
এসময় উভয় দেশের মিত্ররা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দক্ষিণ কোরিয়ার পাশে দাঁড়ায় যুক্তরাষ্ট্র অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন।
ওই যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লাখ সামরিক-বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারায়। ১৯৫৩ সালে এক অস্ত্রবিরতী চুক্তির মধ্য দিয়ে কোরিয়া যুদ্ধ শেষ হয়।
৩৮ ডিগ্রি অক্ষরেখার পরিবর্তে দুই কোরিয়ার মধ্যে নতুন সীমানা রেখা নির্ধারণ করা হয় যার নাম ডিমিলিটারাইজড জোন বা অ-সামরিকীকৃত অঞ্চল।
আড়াইশ কিলোমিটার দীর্ঘ ও চার কিলোমিটার প্রশস্ত এই এলাকা মূলত নামমাত্র বেসামরিক জোন। বাস্তবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সামরিক এলাকা। কেননা সবসময়ই এখানে ১০ লাখের বেশি সেনা মোতায়েন থাকে।
ক্ষমতায় এসে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন কিম ইল সাং। সমাজতান্ত্রিক আদর্শ অনুসারে কৃষি জমি পুনর্বন্টন করেন। শিল্প কারখানা ও অর্থনীতি জাতীয়করণ করা হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বন্ধুহীন হয়ে পড়ে উত্তর কোরিয়া। প্রতিপক্ষের হামলা ঠেকাতে ব্যাপক পরিমাণে অস্ত্র তৈরির দিকে মনযোগ দেন কিম।
২২ বছর শাসন করার পর ১৯৯৪ সালে কিম ইল সাং মারা যান। রাষ্ট্র পরিচালনায় কিমের পদ্ধতিই অবলম্বন করেন তার পূত্র কিম জং ইল। ২০১১ সালে মারা যান কিম জং ইল। ক্ষমতায় আসেন বর্তমান সুপ্রিম লিডার কিম জং উন।
পরমাণু অস্ত্র, ব্যালাস্টিক মিসাইলসহ বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র তৈরিতে রীতিমতো গবেষণা শুরু করেন কিম জং উন। ২০১২ সালে আন্ত-মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালায় পিয়ংইয়ং। এর ফলে বাণিজ্যিক অবরোধসহ বিভিন্ন ধরণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ওয়াশিংটন মিত্ররা।