জানুয়ারি ৭, ২০২৫, ০৩:৪৪ পিএম
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অ্যান টাউনশিপে অবস্থিত সামরিক জান্তার পশ্চিমাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের সদর দপ্তরের পতন হয়েছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির কাছে পরাজিত হয়েছে দেশটির সরকারি বাহিনী। এবার জান্তার অস্ত্র উৎপাদন কারখানার দিকে নজর দিচ্ছে আরাকান আর্মি।
গতকাল মঙ্গলবার এই তথ্য জানিয়েছে মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম ইরাবতি।
অস্ত্র কারখানার অবস্থান
মিয়ানমারে মোট ২৫টি অস্ত্র কারখানা রয়েছে। তার মধ্যে ১৫টি মাগওয়ে প্রদেশে, ৭টি বাগো প্রদেশে, দুইটি রাজধানী নেপিদো`র তাতকোনে এলাকায় এবং একটি ইয়ানগনের তাইককি টাউনশিপে।
মাগওয়ে ও বাগো প্রদেশের দুইটি অস্ত্র উৎপাদন কারখানা ইরাবতি নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত।
জেনারেল নে উইনের বার্মা সোশালিস্ট প্রোগ্রাম পার্টির (বিএসপিপি) আমলে এসব অস্ত্র কারখানার নির্মাণ কাজ শুরু হয়। এর আগে, ১৯৬৮ সালে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি অব বার্মাকে (সিপিবি) বড় আকারে সামরিক সহায়তা দেয় চীন।
ইরাবতি নদী এতদিন পূর্বাঞ্চলের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের যেকোনো হামলায় ‘প্রাকৃতিক সুরক্ষা বলয়’ হিসেবে কাজ করেছে।
ডিসেম্বরে অ্যান টাউনশিপে পশ্চিমাঞ্চলীয় কমান্ডের সদরদপ্তর ও রাখাইন রাজ্যের তাউংগাপ এলাকায় ১৫তম সামরিক অপারেশনস কমান্ড দখল করে নেয় আরাকান আর্মি। এতে নাটকীয়ভাবে পরিস্থিতি পালটে যায় এবং পশ্চিম দিক থেকে অস্ত্র কারখানাগুলোয় হামলা চালানোর পথ সুগম হয়।
যেভাবে দখল হতে পারে অস্ত্র কারখানাগুলো
গত সপ্তাহ থেকে আরাকান আর্মি জান্তার তাউং পোনে জি ঘাঁটিতে তীব্র হামলা চালানো শুরু করেছে। এই শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটির অবস্থান রাখাইন রাজ্য ও বাগো প্রদেশের সীমান্তে। আরাকান পর্বতমালার উঁচু অংশে বেশ সুরক্ষিত অবস্থায় আছে এই তাউং পোনে জি দুর্গ। রাখাইনের তাউংগপ থেকে বাগো`র পানদাউং টাউনশিপের সংযোগকারী সড়কের মাঝামাঝি জায়গায় বেশ কয়েকটি অস্ত্র কারখানা রয়েছে।
এসব হামলার প্রতিশোধে সামরিক জান্তা বিমান হামলা চালিয়েছে। এই হামলায় বেসামরিক নাগরিকরা নিহত হয়েছেন। অনেকে পার্শ্ববর্তী ওকশিতপিন শহরে পালিয়ে গেছেন।
‘কাপাসা’ নামে পরিচিত এই অস্ত্র কারখানাগুলো মূলত মাগওয়ে ও বাগো প্রদেশে ছড়িয়ে রয়েছে।
অ্যান টাউনশিপের পতনের আগেই বিদ্রোহী গোষ্ঠীরা অ্যান-পাদান সড়ক দখল করে নিয়েছিল। পাদানে সামরিক জান্তার ৯০৫ ও ৩৭৫ নম্বর গোলন্দাজ ব্যাটালিয়নের সদর দপ্তরের অবস্থান।
এই দুই ব্যাটালিয়নকে পরাজিত করতে পারলে মাগওয়ে প্রদেশের সব অস্ত্র কারখানা খুব সহজেই দখল করে নিতে পারবে আরাকান আর্মি।
কারখানাগুলোতে কোন ধরনের অস্ত্রের উৎপাদন হয়
প্রথম কারখানাটি পাদান থেকে মাত্র ১৬ কিমি দূরে। নাপে শহরের `কাপাসা ১৪` ক্ষেপণাস্ত্র ও ইলেক্ট্রনিক প্রিন্টেড সার্কিট বোর্ড (পিসিবি) উৎপাদন করে থাকে বলে জানিয়েছে সামরিক প্রকৌশলীরা। এই কারখানাটি সুরক্ষিত এবং এতে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার রয়েছে।
মাগওয়ে প্রদেশে ইরাবতি নদীর পশ্চিম তীরে কাছাকাছি অবস্থানে কাপাসা ২, ১০, ১২, ১৩, ২০ ও ২১ নামের আরও ছয়টি অস্ত্র কারখানার অবস্থান।
মিনহ্লা টাউনশিপের কাপাসা ২ কারখানায় আরপিজি গ্রেনেড ও ভারি ক্যালিবারের অস্ত্র, যেমন ১২০ মিমি, ৮১ মিমি ও ৬০ মিমি মর্টারের উৎপাদন হয়।
কাপাসা ১৩ কারখানায় কামানের গোলা, বিস্ফোরক ও অন্যান্য অস্ত্র উৎপাদন হয়।
সেইকফিইউ টাউনশিপের কাপাসা ২১ কারখানায় বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য বোমা উৎপাদন হয়।
উল্লেখিত এই সাত কারখানার সবগুলোই এখন পশ্চিম দিক থেকে আগাতে থাকা আরাকান আর্মির সেনাদের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করবে বলেই মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
অস্ত্র কারখানার প্রতিরক্ষা ‘দুর্বল’
অত্যাধুনিক অস্ত্র ও কামানের গোলায় সজ্জিত হলেও, এই কারখানাগুলো হাজারো একর জমির ওপর নির্মিত। যার ফলে লোকবল সঙ্কটে এসব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ফায়দা নিতে সক্ষম হবে না সামরিক জান্তা। সর্বশেষ তথ্য মতে, কাছাকাছি কমান্ড সেন্টারের পতনে এসব স্থাপনায় এখন হাতে গোনা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি রয়েছে।
এমন কী, এসব কারখানায় মোতায়েন করা সেনারা অদক্ষ এবং তাদের সম্মুখযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। ধারণা করা হচ্ছে, বিদ্রোহীদের এগিয়ে আসতে দেখলেই তারা লেজ তুলে পালাবেন।
এ অঞ্চলে আরাকান আর্মি ও অন্যান্য বিদ্রোহীদের জন্য একমাত্র সমীহ জাগানিয়া প্রতিপক্ষ হচ্ছে পাদানের গোলন্দাজ ব্যাটালিয়ন। তবে প্রাদেশিক কমান্ডকে পরাজিত করা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তারা কতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন, সেটা নিশ্চিত নয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সহজেই জয়ী হবে আরাকান আর্মি।
রাখাইনের যুদ্ধে জয়লাভের ফলে আরাকান আর্মির অস্ত্রভাণ্ডারে বেশ কিছু ভারী অস্ত্র যোগ হয়েছে। কাপাসা কারখানার বিরুদ্ধে হামলায় তারা এসব অস্ত্র ব্যবহার করবে বলেই ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।
মূলত, অ্যান-মিনবু ও অ্যান-পাদান সড়কের দখল নেওয়ার পর ইরাবতি নদীর পশ্চিম তীরের সবগুলো অস্ত্র কারখানা একে একে দখল করতে পারবে আরাকান আর্মি।