মক্কা ও মদিনার পর মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল-আকসা মসজিদের গ্র্যান্ড খতিব ও ইমাম শায়খ ইকরামা সাইদ সাবরিকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গেছে ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনী-মোসাদের সদস্যরা। এঘটনায় ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে ফিলিস্তিনের জনগণ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। আর ফিলিস্তিনিদের আরও একটি ইন্তিফাদা শুরু হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার।
পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে স্থানীয় সময় মঙ্গলবার তুরষ্কের সংবাদ সংস্থা আনাদোলু এজেন্সি’র প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার তাকে তুলে নিয়ে ইসরাইলি গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাকে এখনও বড়িতে ফেরত পাঠানো হয়নি।
পরিবারের এক সদস্য নাম না প্রকাশের শর্তে আনাদোলুকে জানান, পূর্ব জেরুজালেমের আল-সুহানেহতে অবস্থিত ইমামের বাড়িতে অভিযান চালান ইসরাইলি সেনারা। কোনো কারণ না দেখিয়েই তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তুলে নিয়ে যায় তারা।
তবে আল-আকসার ইমামকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি ইসরাইল সরকার।
ইসরাইলি দখলদারদের সমালোচনা করে প্রায়ই বিভিন্ন বক্তব্য দেন আল আকসা মসজিদের গ্র্যান্ড খতিব ও ইমাম শায়খ ইকরামা সাইদ সাবরি। আর এ কারণে আগে একাধিকবার আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। শুধু তাই নয়, শেখ সাবরির বিরুদ্ধে আল-আকসায় কয়েকবার উস্কানির অভিযোগ এনে তাকে নির্বাসনের আদেশও দিয়েছিল ইসরাইলি সরকার। এমতাবস্থায় আবারও মধ্যপ্রাচ্যসহ পুরো বিশ্বজুড়ে জল্পনা-ফিলিস্তিনিরা কী আবারও ইন্তিফাদা’র শুরু করতে চলেছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রথম ইন্তিফাদা
ইসরাইলি দখলদারিত্বের প্রতিবাদে ১৯৮৭ সালে ‘ইন্তিফাদা’ বা গণজাগরণের আন্দোলন শুরু করেন ফিলিস্তিনিরা। প্রথম ইন্তিফাদা’য় ইসরাইলি বাহিনীর আধুনিক সব সমরাস্ত্রের মোকাবেলায় পাথর ব্যবহার করে ফিলিস্তিনিরা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। ওই আন্দোলনে ১ হাজার ৪০০ ফিলিস্তিনি আর ২৭১ ইসরাইলি নিহত হন।
দ্বিতীয় ইন্তিফাদা
২০০০ সালে দ্বিতীয় দফার ইন্তিফাদা শুরু হয়েছিল। এটি ‘আল আকসা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। দখলদার ইসরাইলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন এক হাজারের বেশি সৈন্যসামন্ত নিয়ে আল আকসা মসজিদ ভ্রমণের পাশাপাশি ভেতরে প্রবেশ করলে ফিলিস্তিনিরা দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (বি্দ্রোহ) শুরু করেন।
২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে এই ইন্তিফাদা চলে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। এটি ‘আল আকসা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। শ্যারনের ওই ভ্রমণ ফিলিস্তিনিদের চোখে ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ন মসজিদের উপর ইজরাইলি দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসাবে প্রতীয়মান হয়। ইসলামে ফিলিস্তিনের বায়তুল মাকদিস এর অবস্থান মক্কা ও মদীনার পরেই। ওই ইন্তিফাদায় মারা যান ৩ হাজার ৩৯২ ফিলিস্তিনি আর ৯৯৬ ইসরায়েলি।
তৃতীয় ইন্তিফাদা
বায়তুল মুকাদ্দাস ইস্যুতে শুরু হয় তৃতীয় ইন্তিফাদা। আল আকসা মসজিদসহ অন্যান্য মুসলিম ঐতিহ্য ধ্বংস করে বায়তুল মুকাদ্দাসকে ইহুদিবাদীদের শহর হিসেবে চিহ্নিত করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে জোরালো প্রতিবাদ শুরু করে ফিলিস্তিনিরা। এরই মধ্যে ২০১৭ সালে জেরুসালেমে মার্কিন দূতাবাস সরিয়ে নেয়া সংক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলে। এমতাবস্থায় ফিলিস্তিনিরা তৃতীয় ইন্তিফাদা শুরু করতে বাধ্য হয়।
ফিলিস্তিনে আবারও ইন্তিফাদা?
আল আকসা মসজিদের ইমামকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং মসজিদ প্রাঙ্গণে দেশটির উগ্র ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়কমন্ত্রী ইতামার বেন-গ্যাভির প্রবেশ করার ঘটনায় নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। ইসরায়েলের মন্ত্রীর এ ধরণের কর্মকাণ্ডকে ‘নজিরবিহীন উসকানি’ বলে মনে করছেন ফিলিস্তিনিরা। এমতাবস্থায় ফিলিস্তিনিদের মাঝে আবারও উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ঘটনায় ফিলিস্তিনিরা আবারও ইন্তিফাদের ডাক দিতে পারেন।
ভিডিও দেখতে এখানে ক্লিক করেন
কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে মঙ্গলবার ইসরায়েলি মন্ত্রীকে আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে পরিদর্শন করতে দেখা যায়। ইসরায়েলি মন্ত্রীর এ ধরনের পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক করে দেশটির বিরোধীদলীয় নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ বলেন, “বেন-গ্যাভিরের এমন সফর নতুন করে সহিংসতার জন্ম দেবে।”
আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে ইসেরায়েলি মন্ত্রীর প্রবেশের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এটিকে ‘নজিরবিহীন উসকানি’ এবং সংঘাতের জন্য ‘বিপজ্জনকভাবে বাড়াবাড়ি’ দেখছে।
অন্যদিকে, বেন গ্যাভিনের আল আকসা মসজিদে প্রবেশের আগে হামাস কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে বলেছিল, তারা বেন গ্যাভিনের পরিকল্পিত সফরের যেকোনো পরিণতির জন্য জন্য ইসরায়েল সরকারকে দায়ি করবে।”
মুসলমানদের কাছে মক্কা ও মদিনার পর সবচেয়ে পবিত্র স্থান আল আকসা মসজিদ।জেরুজালেমে অবস্থিত এই মসজিদে শুধুমাত্র মুসলমানরাই নামাজ বা প্রার্থণা করে থাকেন। তবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের উগ্র ডানপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গ্যাভির এই ব্যবস্থার পরিবর্তন চান। মুসলমানদের পাশাপাশি ইহুদিরাও প্রার্থণা করুক-এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চান তিনি। তবে তার এই চাওয়াকে কেন্দ্র করে ইহুদি সম্প্রদায় ও মুসলমানদের নেতাদের পক্ষ থেকে বাধা ও নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয়েছেন বেন-গ্যাভি।
ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ মনে করছে, আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে বেন গ্যাভির প্রবেশের ঘটনায় এখানকার পরিস্থিতি আবারও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। তার কর্মকাণ্ড স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে। কারণ তারা মনে করছে, উগ্র ডানপন্থী ইসরায়েলিরা অনেক দিন ধরেই আল-আকসা মসজিদের অবশিষ্টাংশে একটি সিনাগগ নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছে।