এক প্রকার বিনা বাধায় আফগানিস্তানের অন্যতম প্রদেশ নাঙ্গারহার প্রদেশের রাজধানী জালালাবাদ দখল করে নিয়েছে সশস্র তালেবান গোষ্ঠী। দেশটির গভর্নর তালেবান যোদ্ধাদের হাতে আত্মসমর্পণ করেছেন। তালেবানদের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় রাজধানী কাবুলের চারদিক দিয়ে আফগান সরকারকে ঘিরে ফেলেছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত শনিবার (১৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় তালেবানরা অনেকটা বিনা বাধায় কাবুলের ৫ কিলোমিটার এলাকায় ঢুকে পড়ে। এরপর তারা কাবুল সরকারকে অবরুদ্ধ করে।
আলজাজিরার খবরে বলা হয়, স্থানীয় সময় রবিবার (১৫ আগস্ট) সকালে জালালাবাদের দখল পুরোপুরিভাবে তালেবানদের হাতে চলে যায়৷ দেশের বড় শহরের মধ্যে একমাত্র রাজধানী কাবুলই এখন পর্যন্ত আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে৷ ইতিমধ্যেই মাজার-ই-শরিফের দখল নিয়েছে তালেবানরা। পশ্চিমাঞ্চলীয় এক প্রশানসিক কর্তা জানিয়েছেন, রাজধানীর বাইরে সর্বশেষ প্রধান শহরের পতন হয়েছে৷
এই প্রদেশের পার্লামেন্ট সদস্য আবরারুল্লাহ মুরাদ বার্তা সংস্থা এপি’কে বলেছেন, প্রবীণরা জালালাবাদে সরকারের পতন নিয়ে সমঝোতা করার পর তালেবানদের হাতে এর নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। এই শহরের আরেকজন আফগান কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, তালেবানদের কাছে গভর্নর নিজেকেই আত্মসমর্পণ করেছেন । তাই সেখানে কোনোই সংঘর্ষ হয়নি। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, বেসামরিক জনগণের জীবন রক্ষার একমাত্র উপায় ছিল আপসে তালেবানদের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া। গভর্নর তাই করেছেন।
তালেবানদের হামলা নিয়ে শনিবার (১৪ আগস্ট) জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। ভাষণে তিনি জানান, আফগানদের উপর নির্মম এই অত্যাচার, হত্যালীলা তিনি মেনে নিতে পারছেন না৷ গত ২০ বছরে যে লাভ হয়েছিল, অচিরেই তা নিঃশেষ হচ্ছে৷
আফগান প্রেসিডেন্ট বলেন, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হচ্ছে৷ এই ধ্বংসলীলা বন্ধ করতে সবরকমভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি৷ প্রেসিডেন্ট ঘানি আরও বলেন, ‘‘দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, হিংসা বন্ধে সব চেষ্টা চালাচ্ছি৷ দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক-স্তরের বন্ধুদের সঙ্গেও পরামর্শ করে চলেছি৷’’
এদিকে, রয়টার্সের খবরে বলা হয়, শনিবার(১৪ আগস্ট) আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লগার প্রদেশ দখল করে তালেবান গোষ্ঠী। লগার প্রদেশের হোমা আহমেদি নামে একজন সংসদ সদস্য দাবি করে বলেন, কাবুল প্রদেশের একটি জেলাতেও তালিবানিরা এরই মধ্যে পৌঁছে গিয়েছে। সেখানেও নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার সবরকম উদ্যোগ নিচ্ছে জঙ্গিরা৷
এর আগে শনিবার (১৪ আগস্ট) কান্দাহারের প্রধান রেডিও স্টেশনটিও তালেবানরা দখল করে নেয়৷ সেই রেডিও স্টেশনের নামকরণ করা হয় ‘ভয়েস অব শরিয়া’৷ অর্থাৎ এবার থেকে ইসলামী আইন মেনে ওই রেডিও স্টেশনে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হবে। তালেবানদের এক নেতা এপ্রসঙ্গে জানায়, এখন থেকে রেডিও স্টেশনে সংবাদ সম্প্রচারের পাশাপাশি কোরআনের বক্তব্যগুলি প্রচার করা হবে৷ এই রেডিও স্টেশনে গান-বাজনার অনুষ্ঠান আর চলবে না৷
কাবুলে সেনা মোতায়েনের নির্দেশ বাইডেনের
এদিকে, দূতাবাসের কর্মীদের নিরাপদে সরিয়ে আনতে আফগানিস্তানে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কারও ওপর কোনো হামলা হলে তাড়িৎ ও কড়া জবাব দেওয়া হবে বলে তালেবানদের কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়, শনিবার (১৪ আগস্ট) প্রেসিডেন্ট বাইডেন একটি দীর্ঘ বিবৃতিতে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারে তার সিদ্ধান্তের পক্ষে আবারও যুক্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, তালেবানদের বিরুদ্ধে আফগান সেনাদেরই লড়াই করতে হবে।
বাইডেন বলেন, “আমাদের কূটনৈতিক, সামরিক ও গোয়েন্দা দলগুলোর পরামর্শের ভিত্তিতে আমি প্রায় ৫ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েনের অনুমোদন দিয়েছি যাতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মী ও অন্য মিত্রদেশগুলোর কর্মীদের সুশৃঙ্খলভাবে ও নিরাপদে কাবুল থেকে সরিয়ে আনা যায়।”
হোয়াইট হাউস সূত্র জানায়, আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দৃশ্যত ধসে পড়েছে। আর তা দেখে হতাশা প্রকাশ করছে পশ্চিমা দেশগুলো। এমন অবস্থায় আফগানিস্তান থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের নিরাপদে পর্যায়ক্রমে উদ্ধারে ৫ হাজার সেনা মোতায়োনের অনুমোদন দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেুসিডেন্ট জো বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিষয়ক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এই সেনাদের মধ্যে থাকবে ৮২তম এয়ারবর্ন ডিভিশনের ১০০০ সেনা সদস্য।
আলজাজিরার খবরে বলা হয়, প্রায় দুই দশক পর আবারও আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফিরতে চলেছে তালেবানরা। টানা দুই দশকের সামরিক অভিযান শেষে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের সৈন্যরা আফগানিস্তান ছাড়ার পর তালেবান যোদ্ধারা একের পর এক এলাকা দখল করে নিচ্ছে। গত ৮দিনে আফগান সেনাদের হটিয়ে তালেবানরা দুই ডজনেরও বেশি প্রদেশ দখলে নিয়েছে। শনিবার (১৪ আগস্ট) পর্যন্ত তারা মোট ৩৪ টি প্রদেশের মধ্যে ২৫টি প্রদেশের রাজধানী দখলে নিয়ে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠার দিকে নজর দিচ্ছে।
কাবুলে শরণার্থীর ঢল
তালেবানের তীব্র হামলার মুখে আফগানিস্তানে এখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছে। এরকম হাজার হাজার মানুষ এখন উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে রাজধানী কাবুলে। এমতাবস্থায় আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি তাদের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। তালেবানদের হাতে মৃত্যুর ভয়ে এসব মানুষ যাতে অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিতে পারে তার জন্য জাতিসংঘ এই আহবান জানায়।
এদিকে, আফগানিস্তানে খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে। সেখানে একটা বিরাট মানবিক বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে তারা হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
সূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, আলজাজিরা, পার্স টুডে।