ফেসবুকে ৪৮ ঘণ্টায় ৩৫ শিশু নিখোঁজ : কিভাবে এত শিশু হারায়?

গোলাম রাব্বানী

জুলাই ৮, ২০২৪, ০৬:১৯ এএম

ফেসবুকে ৪৮ ঘণ্টায় ৩৫ শিশু নিখোঁজ : কিভাবে এত শিশু হারায়?

প্রতীকী ছবি । দ্য রিপোর্ট ডট লাইভ

সম্প্রতি ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে শিশু নিখোঁজ হবার বিভিন্ন পোস্ট সয়লাব হয়ে যায়। এর মধ্যে ৪৮ ঘণ্টায় ৩৫ শিশু নিখোঁজের তথ্যটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। তবে পুলিশ এই ঘটনাকে গুজব বলে একটি আইডি চিহ্নিত করেছে বলে উল্লেখ করে। তবে বাস্তবে হরহামেশাই শিশু হারানোর ঘটনা ঘটে চলছে- সেটা জানাতেই লিখছি এই প্রতিবেদন। চলুন জেনে নেওয়া যাক-

আসলেই কি এত শিশু হারাচ্ছে?

শিশু হারানোর ক্ষেত্রে সঠিক তথ্য পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর কাছে নেই। তবে এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করে সমাজ সেবা অধিদপ্তর। সেখানকার হটলাইন নম্বর ১০৯৮-এ কল করে শিশু নিখোঁজের বিষয়টি জানানো যায়।

সমাজ সেবা অধিদপ্তর হটলাইনের মাধ্যমে বছরে প্রায় ১ হাজার ৬০০ জন নিখোঁজ শিশু তাদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই হিসাব অনুযায়ী দৈনিক ৩ জন শিশু উদ্ধার করেছে তারা। তবে শিশু নিখোঁজের ক্ষেত্রে হটলাইন নম্বরে যোগাযোগকারীর সংখ্যা খুব কম। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ ও পেজেই বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকেন অভিভাবকরা।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবু সালেহ্ মোস্তফা কামাল বলেন, “আমাদের হটলাইনে যোগাযোগ করলে আমরা সেই বিষয়ে পদক্ষেপ নেই। ব্যক্তি-পর্যায় ছাড়া অনেকেই আমাদের হটলাইনে জানায়। তবে আমাদের না জানালে পদক্ষেপও নিতে পারছি না।”

তবে হারানোর ক্ষেত্রে ফেসবুকের গ্রুপ কিংবা ব্যক্তিগত আইডি বা পেজ থেকে পোস্ট দেওয়ার প্রবণতাই বেশি দেখা যায়। ফেসবুকে হারানো বিজ্ঞপ্তি কিংবা নিখোঁজ সংবাদ লিখে সার্চ দিয়ে ৭ জুলাই রোববার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ১৬টি নতুন হারানো ঘটনার সন্ধান পাওয়া গেছে। বিভিন্ন গ্রুপ ও ব্যক্তিগত আইডিতে যেগুলো পোস্ট করা হয়। তাদের মধ্যে বেশির ভাগ ফেসবুক গ্রুপ এলাকাকে প্রতিনিধিত্ব করে। তবে রোববার হারানো বিজ্ঞপ্তিগুলো বেশির ভাগ চট্টগ্রাম, ফেনী, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও বরিশাল অঞ্চল থেকে নেওয়া। হারানো এসব বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে যুক্ত ফোন নম্বরে কল করে জানা গেছে, তাদের সন্তান বা ছোট ভাই হারিয়ে গেছে। আবার অনেককেই হারানো বিজ্ঞপ্তির ২-৩ ঘণ্টা পর খুঁজে পাওয়া যায় বলেও জানা যায়। ফলে ফেসবুকে হারানো বিজ্ঞপ্তির পোস্ট দেওয়ার পর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেননি তারা। আর সন্ধান পাওয়ায় এসব গ্রুপের পোস্ট রিমুভও করেননি।

বরিশালভিত্তিক একটি গ্রুপ ‘গর্বের বাকেরগঞ্জ’ থেকে রোববার দুটি হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এর আগের দিন করা হয় একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ। গ্রুপটির অ্যাডমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত ও পরিচিত হওয়ায় এই ধরনের হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ফলে কোনও আর্থিক সহায়তা না চাইলে সেখানে কেউ প্রতারিত হবে না ভেবেই বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করা হচ্ছে।

এদিকে এই গ্রুপে গত শুক্রবার একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। যেখানে সাকিব হোসেন (ছদ্মনাম- ১৩) একটি ছেলের সন্ধান চেয়ে পোস্ট করা হয়। সেই নম্বরে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে বলা হয়, তাদের সন্তানকে বরিশাল সদর থেকে শনিবার পাওয়া গেছে। তবে পাওয়ার পর কেন পোস্ট সরানো হয়নি বা থানায় যোগাযোগ করা হয়নি? এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন অভিভাবক বলেন, “প্রকৃত অর্থে তখন টেনশন থেকে আনন্দে চলে আসি তাই এগুলো খেয়াল থাকে না।”

একইভাবে শুক্রবার হারিয়ে যাওয়া অনেক পোস্টে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করে জানা গেছে, তাদের নিখোঁজ সন্তান বা ভাইকে খুঁজে পাওয়া গেছে।

পুলিশ বলছে গুজব

শিশু হারানোর বিষয়টি পুরোপুরি গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ। তাদের মতে, পুরো ঘটনাই গুজব। এমন তথ্যের কোনও ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, “আমাদের কাছে বিষয়টি গুজব মনে হয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়েছি, এমন নিখোঁজের কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই। কোনও মহল হয়তো এই তথ্য ছড়িয়ে আতঙ্ক তৈরি করতে চাইছে। কীভাবে এটা শুরু হলো, আমরা খতিয়ে দেখছি।”

শিশু নিখোঁজের বিষয়ে সম্ভাব্য প্রথম ভাইরাল পোস্ট দাতাকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। পোস্ট দাতার নাম ‘সাফিউল্লাহ সাফা’। পুলিশ জানায়, ফেসবুকে গত ৬ ও ৭ জুলাই এ-সংক্রান্ত পোস্ট যারা দিয়েছেন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখা যায়, কোনও কোনও নিখোঁজ শিশুর বিষয়ে না জেনেই পোস্ট দিচ্ছেন কেউ। কোনওটির আবার নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে দেওয়া ফোন নম্বর বন্ধ। কাউকে কাউকে আবার খুঁজে পাওয়া গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, “অস্বাভাবিকভাবে শিশু নিখোঁজ বিষয়টি গুজব হতে পারে। তথ্য শেয়ারের ক্ষেত্রে উচিত আরও সচেতন হওয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব বা এ-সংক্রান্ত সংবাদ দেখলেই সেটা শেয়ার না করে মেইন স্ট্রিম নিউজে ক্রস চেক করা উচিত।”

এদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে সম্প্রতি ‘শিশু নিখোঁজ‍‍’ সংক্রান্ত পোস্ট পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের নজরে এসেছে। ‍‍‘শিশু নিখোঁজ‍‍’ সংক্রান্ত এ-ধরনের পোস্ট নিছক গুজব। এ ধরনের গুজবে বিভ্রান্ত বা আতঙ্কিত না হওয়ার জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছে।

মাদ্রাসা পড়ুয়া শিশু কেন হারাচ্ছে বেশি

রোববার ফেসবুকে হারানো বিজ্ঞপ্তিতে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়, সেখানে দেখা যায় ১৬টি বিজ্ঞপ্তির মধ্যে ১০ জনই মাদ্রাসা পড়ুয়া শিশু। যাদের সবাই হাফেজ হওয়ার জন্য মাদ্রাসায় পড়াশুনা করছিল।

হঠাৎ মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিশু হারানোর প্রবণতা বেশি কেন সে বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মুহাম্মদ শাহ আলমগীর বলেন, “মাদ্রাসার শিশু হারানোর বিষয়ে আমাদের কাছে কোনও তথ্য নেই। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিশু নিখোঁজ হয় না।”

তবে মাদ্রাসা পড়ুয়া মাদ্রাসায় শিশুদের নিখোঁজ বেশি কেন এমন প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি।

রোববার নিখোঁজ ১০ মাদ্রাসাপড়ুয়া শিশুদের মধ্যে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে দুজনকে খুঁজে পাওয়া গেছে। গাজীপুরে কাপাসিয়ায় একজনকে শিশু নিখোঁজ হওয়ার দুই ঘণ্টা পর পাওয়া যায়। শিশুটির অভিভাবক জানান, দুপুরে জোহরের নামাজের পর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। মাদ্রাসা থেকে কাউকে না বলে বাসায় আসতে চেয়েছিল। তবে ভুলে উল্টো রাস্তায় চলে যাওয়ার এমন ঘটনা হয়েছে।

ফেসবুক অ্যালগারিদমের কারণে সয়লাব হারানো বিজ্ঞপ্তি

ফেসবুকের অ্যালগারিদমের কারণে হারানো বিজ্ঞপ্তি ব্যবহারকারীরা বেশি বেশি দেখছে বলে উল্লেখ করেন এএফপির ফ্যাক্টচেকার কদরুদ্দিন শিশির। ফেসবুকে পোস্টের মাধ্যমে তিনি জানান, হারানো বিজ্ঞপ্তি লিখে ফেসবুকে সার্চ দিয়ে গত কয়েকদিনে তার নিউজফিডে বেশ কয়েকটি ‘হারানো বিজ্ঞপ্তি‍‍’র পোস্ট সামনে চলে আসে।

বিগত অনেক দিন ধরে যখন ফেসবুকে কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে কিছু দেখতে চাওয়া হয় তখন এ-সংক্রান্ত একটি পেজ খুঁজে বের করে সেটির কিছু পোস্টে রিঅ্যাকশন দিলে ফেসবুকের অ্যালগোরিদম নিজ দায়িত্বে নিউজফিডে ওই টাইপের কনটেন্ট, পেজ, গ্রুপ বা ওয়েবসাইটের লিংক রিকোমেন্ড করতে থাকে। যদি আমি ওইসবে রিঅ্যাক্ট করতে থাকি তবে একই টাইপের আরও নতুন নতুন পেজ বা কনটেন্ট আসতে থাকে। যদি কয়েকদিন আর ইন্টারঅ্যাক্ট করি না, তবে ধীরে ধীরে সেগুলো সরে যায়।

তিনি আরও বলেন যে, তার ধারণা আলোচ্য শিশু-কিশোর ‘হারানো বিজ্ঞপ্তি‍‍’ সংক্রান্ত পোস্ট নিউজফিডে বেশি বেশি দেখার পেছনে ফেসবুকের অ্যালগোরিদমের ভূমিকা রয়েছে।

Link copied!