‘আমাদের তো সব শেষ হইয়্যা গেল’

মাহাবুব আলম শ্রাবণ

এপ্রিল ১৫, ২০২৪, ১০:২০ পিএম

‘আমাদের তো সব শেষ হইয়্যা গেল’

বঙ্গবাজার এলাকায় ঘোষণা না দিয়েই অবৈধ ও অস্থায়ী দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। ছবি: দ্য রিপোর্ট.লাইভ

‘আমাদের তো সব শেষ হইয়্যা গেল। আমরা কি পাইলাম? হিজড়ারা টাকা দিলো, হিজড়াদের টাকা কোথায়? আমরা কোন জায়গার টাকা পাইছি? আমাদের একটা দেখান।’

বঙ্গবাজার এলাকায় এভাবেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিলেন নাম প্রকাশ না করা একজন ব্যবসায়ী। বঙ্গবাজারে গড়ে ওঠা অবৈধ ও অস্থায়ী দোকান ভেঙে ফেলার ঘটনায় তার মতো আরও অনেক ব্যবসায়ীই নিঃস্ব হয়েছেন। হারিয়েছেন বহু কষ্টে দীর্ঘ দিনের মুনাফাস্থল।

সোমবার (১৫ এপ্রিল) সন্ধ্যায় ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ঢাদসিক) ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে ভেঙে দেওয়া হয়েছে বঙ্গবাজার এলাকার অবৈধ ও অস্থায়ী দোকানপাট। ঢাকা দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি বিভাগের উদ্যোগে এই কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদককে ‘বড়ভাই’ ডেকে বঙ্গবাজারের একজন ব্যবসায়ী ক্ষোভ এবং দুঃখভরা কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের মার্কেট ভাঙবে, ভাঙবে এরকম কথা বলা হয়েছে। এখানে সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে। চাঁদরাতের দিনেও বলা হয়েছে যে মার্কেট ভাঙা হলে আপনাদের নিয়া (নিয়ে) পরামর্শ কইর‌্যাই (করে) মার্কেট ভাঙা হবে। ভালো কথা। অনেকে মাল সরায়ে ফালাইছে (সরিয়ে ফেলেছে), যাদের দোকানপাট আছে। আর যাদের দোকানপাট নেই, এরা মাল রাইখ্যা (রেখে) গেছে।’

অসহায়ত্বের সঙ্গে ওই ব্যবসায়ী যোগ করেন, ‘এখন হঠাৎ কইর‌্যা আজকের এরকম রাত্রীবেলায় যদি এরকম ভাঙচুর কইর‌্যা ফালায়, আপনি চিন্তা কইর‌্যা দ্যাখেন, এই যে লোকগুলো, এই মহিলা, এই বাচ্চা- এরা কে, সিটি করপোরেশনের লোক? এরা আমাদের মালগুলো, আমাদের দোকানের লাইট, আমরা এই ক্ষতিগ্রস্তের পরে লাখ লাখ টাকা খরচ কইর‌্যা পেপার লাগাইছি, বাঁশ-খুঁটি লাগাইছি- এই সবকিছু লাগাইছি। এরা যে সব লুট কইর‌্যা নিয়ে যাইতেছে (যাচ্ছে) ভাই।’

নিজেদের অনিশ্চিত জীবন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে ওই ব্যবসায়ী আরও বলেন, ‘আমরা তো এমনিতেই নিঃস্ব। আমাদের ৯৫ লাখ টাকার মাল পুইড়্যা গেছে। সরকার থেকে, আল্লার কসম, একটা টাকাও অনুদান পাই নাই। একটা টাকাও অনুদান পাই নাই, ভাই। তারপরেও আমাদের এখান থেকে হঠাৎ করে এরকম কইর‌্যা অঘোষিত ভাঙা এরকম। অঘোষিত, এইটা কোনো ঘোষিত না।’

জোর গলায় তিনি বলেন, ‘মানুষরে আমরা তো এইখানে ব্যবসায়ীরা আছি। আমাদের বলা হবে। একটা সাইনবোর্ড লাগাইছে। বলছে যে, কার্যক্রম বন্ধ, হ্যানত্যান। কিন্তু আমাদের যে ভাইঙ্গ্যা ফালাইল, ভাই, আমাদের মালগুলো সব লুট করে নিয়ে গেল ভাই, এই দায়ভার কে নিবে? ভাই, বলেন তো?’

সিটি করপোরেশন থেকে তো নোটিশ দেওয়ার বিষয়টি দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদক ওঠালে ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘ভাই, একটা নোটিশ আমারে দ্যাখান। কুন দোকানে, আমি কসম, আমি কসম, আমি কোরআন শরিফ ছুঁইয়্যা কসম খামু, আমার ঘর ছুঁইয়্যা কসম খামু, আমাদের কুনো নোটিশ দেওয়া হয় নাই সিটি করপোরেশন থিক্যা। আমি কাবাঘর ছুঁইয়্যা কসম খামু যে, সিটি করপোরেশন থিক্যা কুনো নোটিশ দেওয়া হয় নাই। এ সব বানোয়াট, সব নাটক, ভাই। এরা সব মনমর্জিমতোন করতেছে।’

বঙ্গবাজারের অবৈধ ও অস্থায়ী দোকান উচ্ছেদের সমালোচনা করে এটা কোন ধরনের আইন, কোন ধরনের ব্যাপার- বলেও প্রশ্ন তোলেন ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘আমরা কত কষ্ট করে এই মাল, এখন আমাদের কি হইবো? দোকান ভাইঙ্গ্যা চুইর‌্যা নিয়্যা আমাদের কোনো কাজে আসতেছে?’

বঙ্গবাজারে অবৈধ ও অস্থায়ী দোকান উচ্ছেদের ঘটনায় বিচার প্রার্থনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা কার কাছে বিচার চাই। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিচার চাই। আর কারও কাছে বিচার চাই না। আর প্রধানমন্ত্রী যদি বিচার করতে না পারে, তাহলে ওই উপরে যিনি আছেন, কাল কেয়ামতের দিন তার বিচার হইবো ইনশাআল্লাহ।’

ঘোষণা ছাড়াই বঙ্গবাজার এলাকায় অবৈধ ও অস্থায়ী দোকান উচ্ছেদের ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ছবি: দ্য রিপোর্ট.লাইভ

বঙ্গবাজার এলাকায় আরেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি বলতে চাইছিলাম, এখন যারা দোকানদার আছে, তারা তো সবাই দেশের বাড়িতে আছে। বা যার যার বাড়িতে আছে। এখন এ্যারা যদি না থাকে, যার যার জিনিস, এ্যারা এ্যারা কীভাবে নিবো?’

নিজের অবস্থার উন্নয়ন হয়নি জানিয়ে ওই ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘মাল লোড কইর‌্যা সব নিয়্যা যাইতেছে, ভাই। এর আগেরবারও লুট করে সব নিয়্যা গেছে মানুষজন। এখনও লুট কইর‌্যা নিয়্যা যাইতেছে। আমরা যেই ফকিরই, সেই ফকিরই রইয়্যা গ্যালাম, ভাই।’

কাঁদো কাঁদো গলায় তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কী কইর‌্যা খামু, বুঝতেছি না। এই দোকান পুইড়্যা গ্যাছে। হ্যাগো তো পুনর্বাসন সুন্দরবন স্কয়ারে দেওয়া হইছে। এই মার্কেট তো আবার নির্মাণ হইবো। ৩০ লাখ টাকার দোকান আবার ৩ কোটি টাকা হইয়্যা যাইবো। মালিকরা তো সব জমিদার, মালিকরা তো সব কোটিপতি। আমরা তো সারা জীবন তাদের ভাড়া দিছি। ৩০ লাখ টাকা দোকান ভাড়া, তারা এরকম লাখ লাখ টাকা, কোটি কোটি টাকা ভাড়া খাইছে। আবার লাখ লাখ টাকা তারা পাইয়্যা যাইবো। কিন্তু আমরা যে সাধারণ জনগণ, যে এত কষ্ট কইর‌্যা, মাথার ঘাম পায়ে ফালায়ে ব্যবসা করি। আমাদের তো সব শেষ হইয়্যা গেল। আমরা কি পাইলাম? হিজড়ারা টাকা দিলো, হিজড়াদের টাকা কোথায়? আমরা কোন জায়গার টাকা পাইছি? আমাদের একটা দেখান। আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। আমাদের অনুদানের ট্যাকা দ্যান, আমরা নিজেরাই ভাইঙ্গ্যা দিয়্যা চইল্যা যামু। ঈদের আগের কথা। এরকম হঠাৎ কইর‌্যা ভাইঙ্গ্যা দিছে। এটার কোনো মানে আছে, বলেন?’

বঙ্গবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘যেমন ক’দিন আগেও আমরা দোকানে চার-পাঁচ হাজার কইর‌্যা টাকা লাগাইছি। (অন্য ব্যবসায়ীদের কাছ পুনর্প্রশ্ন করে) কী ভাই লাগাইছি কিনা? এই যে রোজার মধ্যে আমাদের এইগুলো করাইছে। আমরা তো বাড়িতে ছিলাম। আমরা তো খবর পাইয়্যা আইছি যে দোকান ভাঙতেছে।’

বঙ্গবাজার এলাকায় অবৈধ ও অস্থায়ী দোকান উচ্ছেদের নামে চলছে ব্যবসায়ীদের জিনিসপত্র ‘লুটপাট’। তবে কাদের অঙ্গুলিহেলনে এই ‘লুটপাট’ হয়েছে সেটি নিয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। আবছায়া শোনা গেছে, সিটি করপোরেশনের নির্দেশে তারা এসব নিয়ে যাচ্ছেন। ছবি: দ্য রিপোর্ট.লাইভ

মার্কেটের কমিটি ব্যবসায়ীদের আগে থেকে কিছু জানায়নি বলে অভিযোগ তুলে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের মার্কেটের কমিটি তো আগে থেকে কিছু জানায় নাই। ইচ্ছা করলে মার্কেটের কমিটির লোকজনেরই আমাদের জানানো উচিত ছিল। এই নোটিশ তো কোম্পানির। মার্কেট কমিটিঅলারা আমাদের কিছুই বলে নাই।’

কর্তৃপক্ষের কাছে অনুদানের না পাওয়া টাকা ফেরত পাওয়ার দাবি জানিয়ে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমরা চাই এখানে বিল্ডিং হোক। কিন্তু আমাদের যে অনুদানের টাকা, এই অনুদানের টাকার এক টাকাও আমরা হাতে পাই নাই। এবং আমরা অ্যাডভান্স দিয়্যা যে দোকান পরিচালনা করেছি, ওই টাকাও আমরা ফেরত পাই নাই।’

ব্যবসায়ীদের অভিযোগের ভিত্তিতে মালামাল লুট করে যারা নিয়ে যাচ্ছেন তাদের একজন নারীর সঙ্গে দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদকের কথা হয়েছিল। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘এগুলো কেন নিয়ে যাচ্ছেন?’ এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি ওই নারী। ক্যামেরা থেকে ধীরে ধীরে আড়াল করতে থাকেন তিনি।

বঙ্গবাজার এলাকায় অবৈধ ও অস্থায়ী দোকান উচ্ছেদের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দুঃখ আর পরিতাপ চোখে দেখা যায় না। ছবি: দ্য রিপোর্ট.লাইভ

দ্য রিপোর্টের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, বঙ্গবাজারের অবৈধ ও অস্থায়ী দোকানপাট উচ্ছেদকারীরা সিটি করপোরেশনের লোক নয়। ব্যবসায়ীদের সম্পদ লুট করতে থাকা একজনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি কি সিটি করপোরেশনের লোক?’ জবাবে সরাসরি তিনি বলে ওঠেন, ‘জ্বী না।’ পরক্ষণেই তাকে প্রশ্ন করা হয়, ‘তাহলে এগুলো (ব্যবসায়ীদের সম্পদ) কেন নিয়ে যাচ্ছেন?’ ফিরতি জবাবে ওই লোক বলেন, ‘হ্যারা ভাঙছে। বলছে, নিয়্যা যান।’

তাহলে কারা বলছে, ব্যবসায়ীদের সম্পদ নিয়ে যেতে? আরেকজনের কাছে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘হ্যারা বলছে, নিয়ে যেতে, হ্যারা সিটি করপোরেশনের লোক।’ আবারও তাকে একই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এখানকার লোকই (নিয়ে যেতে বলেছে)। যারা দোকানপাট করে।’

দোকানিদের লুটপাটের অভিযোগের বিষয়টি ওঠালে অকপটে অস্বীকার করেন ওই লোক। তিনি বলেন, ‘যারা যারা আছে কতজন দেশে গ্যাছেগা, বেড়াইতে গ্যাছেগা। এর ভিতরে ভাইঙ্গ্যা দিছে। এইডি কি করবো? আজ রাতের ভিতর সাফ করতে বইলছে।’ কিন্তু কে বলছে সাফ করতে? জবাবে তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের লোক সাফ করতে বলছে।’ কিন্তু কোন লোক বলছে এমন প্রশ্নের জবাবে সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।

প্রসঙ্গত, বঙ্গবাজারে এর আগে গত বছরের ৪ এপ্রিল ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারকে আধুনিক রূপদান এবং সেখানে ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি। পাশাপাশি বঙ্গবাজারের নাম পরিবর্তন করে রাখা হচ্ছে ‌‌বঙ্গবাজার পাইকারি নগর বিপণি বিতান।

Link copied!