প্রার্থী বাছাইয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিৎ যোগ্য প্রতিনিধিকে প্রাধান্য দেওয়া। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যে কোনো নির্বাচনেই এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক চর্চায় এই বিষয়টিকেই বেশি অবহেলা করা হয় সবচেয়ে বেশি। এ লেখায় চলমান ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভোটে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থী বাছাই নিয়েই দুটো ঘটনার কথা তুলে ধরবো। যেহেতু বিরোধী দলগুলো সেভাবে এবার মাঠে নেই। উপরন্তু আওয়ামী লীগের প্রার্থী মানেই নিশ্চিত ‘পাশ’ বলে ধরে নিচ্ছেন অনেকে। হচ্ছেও তাই। ফলে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী বাছাই নিয়েই কিছু কথা বলি আজ।
সারাদেশ থেকে আওয়ামী লীগের তৃণমূল ভোটের প্রার্থী বাছাই নিয়ে যে ‘নয়-ছয়’ এর খবর পাই, এ দুটি স্থানের প্রার্থী বাছাইয়ের ঘটনা থেকেও তার আন্দাজ কিছুটা হলেও মিলবে। কথায় আছে, পাতিলের দু-চারটা ভাত টিপলেই বুঝা যায় সব ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা।
যে দেশের তৃণমূল মানুষ ক্ষেতের আইল নিয়ে শালিস বৈঠকে বসেও পক্ষ নেয় ''কে আওয়ামী লীগ আর কে বিএনপি করে'' সেটা দেখে, সে দেশে ইউনিয়ন পরিষদের মতো অরাজনৈতিক একটি নির্বাচনী আনন্দে সহিংসতার বিষ ছড়িয়ে দেওয়া যে ঠিক হয়নি তা এরইমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। চলতি বছর তৃণমূল এই নির্বাচনী কেওয়াজে নিহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। আহত হয়েছেন ছয় হাজারেরও বেশি। নির্বাচনের বাকি আছে আরও বহু ইউনিয়নে।
পাঁচ বছর আগে তৃণমূলের এই ভোটে প্রার্থীদেরকে রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে তাদের হাতে দলীয় প্রতীক ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই আনন্দের ভোট হয়ে গেছে ভয়-ভীতি, বিভীষিকার। অথচ এক কালে ইউপি নির্বাচন ছিল তৃণমূলের উৎসবের একটি উপলক্ষ। পাঁচ বছর পরপর এই উৎসব আসতো। এখন সেটি আর নেই।
আমরা রাজধানী ঢাকায় বসে তৃণমূলের স্থানীয় নির্বাচনের যে খবর পাই, সে সবই গ্রোগ্রাসে গিলি। প্রকৃত চিত্র আসলে পুরোপুরি ভিন্ন। নানা বিশৃঙ্খলার যে খণ্ডচিত্র পাই, সেগুলোও প্রকৃত চিত্রের একেবারে ছিটেফোটা মাত্র! নির্বাচনে ঘটে যাওয়া খুব কম ঘটনাই আমাদের মিডিয়াদর্পণে ধরা পড়ে। কারণ স্থানীয় সাংবাদিকদের সবার ঘাড়েই একটি করে মাথা! কে চাইবে ক্ষমতাসীন দলের কামড়াকামড়ির সত্য ঘটনা তুলে ধরে নিজের পৈত্রিক প্রাণটা হারাতে? ফলে গতানুগতিক ভোটের খবর পাঠিয়েই তারা দায় সারেন। ঢাকা থেকে মিডিয়াগুলোও সেসব নিউজ কাভার করেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে।
সম্প্রতি পৌষপার্বণ উৎসব করতে ঘুরে এলাম এমন দুটি এলাকা যেখানে ইউপি নির্বাচন হচ্ছে। এলাকা দুটির একটি সিরাজগঞ্জ ও অন্যটি টাঙ্গাইল। ঢেঁকি স্বর্গে গেলে যেমন ধান ভানে, সাংবাদিক কোথাও গেলেও সে সংবাদই খুঁজবে। আমি পৌষপার্বণের পিঠা খেতে গেলেও তাই এই দুই জেলার চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কিছুটা খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করলাম। জেলার সর্বত্র ঘোরার যেহেতু সময় পাব না বিধায় দুই জেলার দুটি ইউনিয়নের মানুষদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। এরমধ্যে সিরাজগঞ্জের যে ইউনিয়নটির খোঁজ নিলাম সেখানকার নির্বাচন এখনও অনুষ্ঠিত হয়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই সেখানে ভোট হবে। বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সেখানে সমানে চলছে জোরদার মাইকিং। আগে থেকে রেকর্ড করা নানা স্লোগান ও সঙ্গীত বাজছে চলতি পথের রিকসাভ্যানের মাইকে। সন্ধ্যার পরই বের হচ্ছে মিছিল। চায়ের স্টলে চোখে পড়ার মতো ভিড়। রীতিমত উৎসবমুখর এক পরিবেশ। কিন্তু আছে সহিংসতার শঙ্কাও।
এ সময়ে নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পাওয়া এক বিশাল সৌভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে-ই নৌকা পাচ্ছে, সে-ই পাশ করছে। ফলে কথায় কথায় স্থানীয় কয়েকজনকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাস করলাম, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী কে এখানে? তার অবস্থা কেমন? তারা জানালেন, অমুক গ্রামের তমুক লোক নমিনেশন পেয়েছেন। বললাম, তিনি কি পাশ করতে পারবেন? তারা নৌকার সমর্থক হয়েও বললেন, সুষ্ঠু ভোট হলে স্বতন্ত্র পাশ করবে।
চলমান নির্বাচনে নৌকাই সাধারণত ফেভারিট এখন। কিন্তু স্বতন্ত্র পাশ করবে শুনে খটকা লাগল। বললাম, নৌকার মনোনয়ন কি ভাল হয়নি তাহলে? তারা জানাল, যিনি যোগ্য ছিলেন তাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তিনি দলের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল। এ কারণে ভোট থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। আর যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তিনি দস্তখত দিতে কলম ভেঙে ফেলেন! নানা অপকর্ম করে টাকার পাহাড় গড়েছেন। সেই টাকার জোরেই তিনি মনোনয়ন পেয়েছেন। অথচ জনগণের সাথে কোনো যোগাযোগই নেই তার।
সিরাজগঞ্জের ওই ইউনিয়নের যখন এই পরিস্থিতি, তখন টাঙ্গাইলের একটি ইউনিয়নের খবর নিলাম। সেখানে অলরেডি ভোট হয়ে গেছে। নৌকা পাশ করেছে। সেই পাশ নিয়ে ভেতরের নানা কথা এখন উড়ে বেড়াচ্ছে। স্থানীয়রা জানালেন, এই চেয়ারম্যান ‘রাজনীতির চালাকি খাটিয়ে’ পাশ করেছেন। ভোটের কয়েকদিন আগে তিনি যখন বুঝতে পারলেন তিনি নির্ঘাৎ ফেল করবেন, তখনই রাজনীতির চাল খাটিয়েছেন। আওয়ামী লীগেরই স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বেকায়দায় ফেলতে তিনি নিজের কর্মীদের দিয়ে রাতের আঁধারে নিজেরই পোস্টার ছিড়েছেন, সেগুলোতে গোবর মাখিয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, খবরটি তিনি উপর মহলে নালিশ আকারে জানিয়ে রীতিমত কান্নাকাটি করেছেন! এর ফলও তিনি পেয়েছেন। ওপর মহলের নেতাকর্মীরা গিয়ে স্বতন্ত্রের ওপর চড়াও হয়েছে, ভোটের দিন স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীদের কেন্দ্রছাড়া করেছে। ফাইনালি এভাবে তিনি একতরফাভাবে পাশও করেছেন। ফেল করেছেন আওয়ামী লীগেরই ভাল একজন প্রার্থী; কিন্তু যার পরিচয় ছিল স্বতন্ত্র!
প্রার্থী বাছাইয়ের এই সঙ্কট শুধু আওয়ামী লীগেরই নয়, অন্য দলগুলোরও। দলগুলো যদি ভাল ও যোগ্য প্রার্থীদের বাছাই করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দিনকে দিন রাজনীতি ‘নষ্টদের’ হাতে চলে যাবে। যদিও নষ্টদের হাতে যাওয়ার বেশি বাকিও নেই। সেটি কী ইউপিতে, কী পৌর বা সংসদ নির্বাচনে। আগে ইউপি নির্বাচনে ছিল একদলের সাথে আরেক দলের কোন্দল; এখন সেটা অন্তর্কোন্দলের জঘন্য রূপ নিয়েছে।
এক সময় সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর সর্বনিম্ন স্তর ইউপি নির্বাচন ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষপাতের বাইরে। এখন দলভিত্তিক নির্বাচনের কারণে সংঘাত-সহিংসতা আগের চেয়ে বহুগুনে বেড়েছে। যে কোনো উপায়ে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন নিতে অসৎ প্রতিযোগিতায় রাজনৈতিক অবক্ষয়ও ঘটছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ফায়দা হাসিলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন। আবার সরকারি দলের প্রতীকবঞ্চিত নেতারাও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে পেশিশক্তি দেখাচ্ছেন, যার অনিবার্য ফল দাঁড়াচ্ছে সহিংসতা।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, শুধু ইউপি নির্বাচনই নয়, স্থানীয় সরকারের অন্যান্য নির্বাচনেও খুনোখুনি ও সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচন ঘিরে ৪৬৯টি সহিংসতার ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮৫ জন। আহত হয়েছেন ছয় হাজারের বেশি মানুষ। ১০ নভেম্বরের পর আরও ১১ জন নিহত হয়েছেন। সবমিলিয়ে শুধু চলতি বছরই নির্বাচনী সহিংসতায় ৯৬ জনকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এই সহিংসতার বেশিরভাগ ঘটেছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পরস্পরের মধ্যে। হতাহতদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।
একটা সময় ইউপি নির্বাচন মানে ছিল গ্রামবাংলায় ভোটের উৎসব। তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের মানুষ একে অপরের সঙ্গে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি বজায় রেখে এই উৎসবে অংশ নিতেন। কিন্তু দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা চালুর পর সেই সম্প্রীতি ও সদ্ভাব কমেছে বহুলাংশে। তার বদলে তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় পরিবেশ। তারওপর অযোগ্য প্রার্থীর মনোনয়ন দলের সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ ও দ্বন্দ্বকে উস্কে দিচ্ছে। ঘটে চলেছে সহিংসতার নয়া মাত্রা। অযোগ্য ও নীতিহীন এই প্রার্থীরা মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে গোড়াতেই যে অনৈতিকতার আশ্রয় নিয়ে ভোটে জিতে চলেছে, এরা যে জনকল্যাণের চেয়ে নিজের কল্যাণই বেশি করবে— এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। এতে সরকার তার দলের ক্ষতি করবে, তৃণমূলের মানুষও উন্নয়ন বঞ্চিত হবে। ফলে এই প্রবণতা থেকে যত দ্রুত পারা যায় বের হয়ে আসতে হবে, না হলে সামনে আরও সমূহ বিপদ অপেক্ষা করছে গণতন্ত্রের জন্য।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট