চীন ও রাশিয়া কেন পশ্চিমা বিরোধী নীতি পোষণ করে?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মার্চ ৪, ২০২২, ০৩:৪২ পিএম

চীন ও রাশিয়া কেন পশ্চিমা বিরোধী নীতি পোষণ করে?

রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর আগপর্যন্ত, চীন ও রাশিয়া থেকে পশ্চিমারা যে তাদের সম্পূর্ণভাবে সরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে, সেটা অসম্ভব ও নির্বোধের সিদ্ধান্ত বলে ভাবা হতো। ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরোধিতা করায় গের্গিয়েভকে যে অপসারণ করা হলো, সেটা চীন-রাশিয়া অক্ষশক্তির প্রতীক। সংস্কৃতি থেকে বাণিজ্য—সবখানেই একটা ফাটল তৈরিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে এই সম্পর্ক। সর্বোপরি, আগ্রাসন শুরুর আগপর্যন্ত অনেকের সন্দেহ থেকেই গিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (বিশেষত জার্মানি) রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস হাতছাড়া করবে কি না। একইভাবে অনেকের সন্দেহ ছিল, যুক্তরাষ্ট্র কি চীনের তৈরি কম খরচের পণ্যের আসক্তি কাটাতে পারবে? বিশ্বায়নের শান্তিপূর্ণ দিনগুলোতে যখন ‘ডাভোস ম্যান’ পৃথিবী শাসন করতেন, তখন দুই পক্ষেরই জয়ের একটা সুবাতাস বয়ে যেত। বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় সবার জন্য মুনাফার সুযোগ সৃষ্টির বাধ্যবাধকতা ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, দূরের কোনো দেশ যদি সস্তায় পণ্য তৈরি করে এবং সেই পণ্য যদি দ্রুত পৌঁছানো যায়, তাহলে সেটা নিতে বাধা কোথায়? মুক্ত বাজার আরও মুক্ত সমাজের জন্য ওকালতি করে। তবে কোনো দেশের রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক অবস্থান বিবেচনা না করেই আমরা আন্তরাষ্ট্রীয় বাণিজ্য অব্যাহত রেখেছি। পশ্চিম ও বাকি বিশ্ব এটা করে এখন রাশিয়ার ওপর গ্যাসের জন্য এবং চীনের ওপর খনিজ ও রাসায়নিক দ্রব্য, পলি সিলিকন, প্রসাধনী এবং ভোগ্যপণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই অপ্রত্যাশিত ও বিনাশী পথে বিশ্বকে কে নিয়ে এল? কেন পুতিন রাশিয়ার একসময়কার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইউক্রেনে হামলা চালাল? কেন সি চিন পিং একটা দ্বীপ করায়ত্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন যেখানে এক শ বছরের বেশি সময় চীনের শাসন নেই। বিশ্ব যখন পারস্পরিকভাবে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার মধ্য দিয়ে আরও বেশি আধুনিক মননশীলতার চর্চায় উৎসায়ী হয়ে উঠছিল, সে সময়েই কেন এই দুই কর্তৃত্ববাদী শাসকের এ ধরনের ধ্বংসাত্মক নীতি গ্রহণ করতে হলো? এই অপ্রত্যাশিত ও বিনাশী পথে বিশ্বকে কে নিয়ে এল? 

প্রথমত, স্বৈরশাসকেরা সাধারণত অসংযমী পথে হাঁটতে অনেক বেশি স্বাধীন। কেননা রাজনৈতিকভাবে ভারসাম্য রক্ষার খুব একটা চর্চা তাদের করতে হয় না। একজন শীর্ষ নেতা তার চরিত্রের ধরন অনুযায়ী, কারও কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই নীতি নির্ধারণ করেন। পুতিন ও সি চিন পিং ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী হলেও তাঁদের দুজনের মধ্যে কিছু মূল বৈশিষ্ট্যে মিল রয়েছে। তাঁরা দুজনেই গভীরভাবে অনিরাপদ বোধকারী ও ভ্রমগ্রস্ত ব্যক্তি। পশ্চিমের ‘বড় শক্তি’র বিরুদ্ধে ক্ষোভই তাঁদের ঐতিহাসিক বয়ান। তাঁদের এই বয়ানের উৎস হচ্ছে বিদেশি শাসন ও শোষণসম্পর্কিত লেনিনবাদী ভাবনা। তাঁরা পশ্চিমা গণতন্ত্রকে ভণ্ডামি বলে মনে করেন (লেনিনের সাম্রাজ্যবাদ তত্ত্ব)। তাঁরা পশ্চিমাদের প্রতি অহংকারী ও অপমানজনক মনোভাব পোষণ করেন। 

পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে চীন ও রাশিয়ার যৌথ এ ক্ষোভ সাবেক দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে এতটাই কাছে নিয়ে এসেছে যে গত মাসে বেইজিংয়ে পুতিন ও সি চিন পিং এক যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের অংশীদারত্বের কোনো ‘সীমা’ নেই বলে ঘোষণা করেছেন। দুই নেতাই তাঁদের দেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে কি না, সেটা জনগণের সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন। পুতিন ও সি চিন দাবি করেন, তাঁরা নতুন একধরনের গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছেন। যদিও পুতিন নিজেকে জারের সঙ্গে কিংবা সি চিন পিং নিজের দেশের শাসনব্যবস্থাকে, ‘সর্বহারার গণতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র’ ভাবতেই পছন্দ করেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, পুতিনের যুদ্ধ ঘোষণার পরও রাশিয়া ও চীন কি তাদের সুবিধাবাদী এই চুক্তি বজায় রাখতে পারবে? আগ্রাসন শুরুর ঠিক আগে, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে বলেন, সব দেশের ‘সার্বভৌমত্ব’ ও ‘সীমানাগত অখণ্ডতা’ অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। ইউক্রেনও এর বাইরে নয়। পরবর্তীতে সি চিন পিং পুতিনের কাছে এর ব্যাখ্যা দেন। রাশিয়ার নিরাপত্তাজনিত যে শঙ্কা, তা তিনি বুঝতে পারছেন বলে জানান। তিনি বলেন, জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রাশিয়া সম্মান করে এবং এ বিষয়ে জাতিসংঘ সনদের যে নীতি, তা ঊর্ধ্বে তুলে ধরার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। সর্বোপরি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কখনোই চায় না বিদেশি শক্তি রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাক।

এই দুটি অবস্থানের মধ্যে শেষে কোনটা জিতবে? চীন ও রাশিয়া—দুটি দেশই উনিশ শতকের উদারনৈতিক গণতন্ত্রের এমন একটি ধারার চর্চা করে যেখানে মনে করা হয় জাতীয় সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। দোষারোপের এই মনস্বত্ব দুই দেশের জাতীয়তাবাদে জ্বালানি জোগায়।

Link copied!