ইউক্রেনে হামলাকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও পশ্চিমা মিত্রদের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই রাশিয়ার কাছ থেকে ডিসকাউন্টে প্রচুর পরিমাণ তেল কিনছে ভারত। এর ফলে ভারত হয়তো মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এমনটাই মনে করছেন মার্কিন প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। মার্কিন প্রশাসনের এক প্রবীণ কর্মকর্তা সংবাদসংস্থা রয়টার্সকে এরইমধ্যে বলেছেন, ইউক্রেনে রুশ হামলার পর ভারত যে হারে মস্কো থেকে তেল কিনছে, তার ফলে তারা ভবিষ্যতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে পারে।
কিছুদিন আগেই বাইডেন প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়েছিল, ভারত যদি ডিসকাউন্টে রাশিয়া থেকে তেল কেনে, তাহলে অ্যামেরিকার কোনো আপত্তি নেই। কারণ, এখন যে নিষেধাজ্ঞা চালু আছে, তাতে রশিয়া থেকে তেল কেনার কোনো বাধা নেই। এখন মার্কিন কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, স্বাভাবিক ভাবে তেল কিনলে অ্যামেরিকার কোনো আপত্তি নেই। স্বাভাবিক ভাবে মানে অন্যান্য বছর রাশিয়া থেকে যে পরিমাণ তেল কেনা হতো, এখনও সেই পরিমাণ বা তার সামান্য কম-বেশি তেল কেনা যেতে পারে। কিন্তু পরিমাণটা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে অসুবিধা রয়েছে।
রাশিয়া ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্র। ছবি: এএফপি/গেটিইমেজ
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এবং অর্থনীতি বিষয়ক মার্কিন ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসার দলীপ সিং ভারত সফরে আসছেন। তার আগে মার্কিন প্রশাসনের তরফে এই ধরনের মন্তব্য যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। দলীপ সিং আবার রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মূল পরিকল্পনাকারী।
রয়টার্স যে হিসাব দিচ্ছে তা হলো, ২০২১ সালে সারা বছর ধরে রাশিয়া থেকে ভারত ১৬ মিলিয়ন ব্যারেল তেল কিনেছে। আর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার পর থেকে এখনো পর্যন্ত ভারত রাশিয়া থেকে ১৩ মিলিয়ন ব্যারেল তেল কিনে ফেলেছে। এখানেই অশনি সঙ্কেত দেখছে অ্যামেরিকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, রাশিয়ার তেল কেনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিছু বেশি পরিমাণ তেলও কেনা যেতে পারে। কিন্তু সেটা যেন সীমা না ছাড়ায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ''আমরা চাই, ইউক্রেনে লড়াই অবিলম্বে শেষ হোক। তার জন্য রাশিয়াকে চাপ দিতে হবে। ফলে ভারত সহ অন্য দেশগুলি যদি নিষেধাজ্ঞার শর্ত না মানে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে।''
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়ার তেলের বিক্রি কমেছে। আগে বিশ্বে প্রতিটি ১০ ব্যারেল তেলের মধ্যে এক ব্যারেল রাশিয়ার থকত। কিন্তু এখন বিশ্ববাজারে প্রতিদিন রাশিয়ার তেল ৩০ লাখ ব্যারেল কম বিক্রি হচ্ছে। সূত্র জানাচ্ছে, ভারত রাশিয়াকে তেলের দাম রুপিতে দিক বা ডলারে, তাতে অ্যামেরিকার কিছু যায় আসে না। তাদের একমাত্র দাবি, সীমার মধ্যে থেকে তেল কিনতে হবে।
ভারত কি মার্কিন নির্দেশনা মানবে?
অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দাশগুপ্ত এবং যোজনা কমিশনের সাবেক আমলা অমিতাভ রায় দুজনেই মনে করেন, ভারতের পক্ষে রাশিয়াকে যেমন চটানো সম্ভব নয়, তেমনই অ্যামেরিকার বিরাগভাজন হওয়াও সম্ভব নয়।
দীপঙ্কর দশগুপ্ত মনে করেন, কূটনৈতিক দিক থেকে দেখলে, রাশিয়ার সঙ্গে চীন ও পাকিস্তানের সম্পর্ক খুবই ভালো। তাই ভারত রাশিয়াকে চটাতে চায়নি ও চাইবেও না। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''তেলকে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে রাশিয়া ও অ্যামেরিকার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে পৌঁছবে তা বলা শক্ত। কূটনৈতিক দিক থেকে ভারত অ্যামেরিকা বা রাশিয়া কারও শত্রু হতে পারবে না। রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা না করলে তারা পুরোপুরি চীন ও পাকিস্তানের দিকে চলে যাবে। তাই ভারত বরাবরই রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক দিক থেকে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে।''
অমিতাভ রায় বলেছেন, ''স্বাভাবিকভাবেই ভারত নিজের স্বার্থ দেখবে। তবে অ্যামেরিকার সঙ্গে কূটনৈতিক স্তরে ভারত আলোচনা দীর্ঘায়িত করবে। সেই সুযোগে বেশি তেল কিনবে রাশিয়ার থেকে।'' তার দাবি, ''অ্যামেরিকা যদি ভারতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে নিজেরাই বিপাকে পড়বে। কারণ, ভারতের মতো এত বড় বাজার তারা পাবে না। সেজন্য অতীতেও ভারতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে লাভ হয়নি।
দীপঙ্কর দাশগুপ্ত মনে করেন, ''অর্থনীতির দিক থেকে দেখতে গেলে তেলের দাম যেভাবে বাড়ছে। যুদ্ধের বাজারে তেলের দাম যে জায়গায় গিয়ে পৌঁছচ্ছে, তাতে ভারত একটা বিকল্প জায়গা তৈরি করতে চাইছে। রাশিয়া এটা চায়। তেলের দাম যে ডলারে নিয়ন্ত্রিত হয়, তা নিয়ে ইউরোপের অনেক দেশের মতো রাশিয়ারও আপত্তি আছে।'' তার মতে. ''রাশিয়া যে রুবলে তেল নেওয়ার কথা বলছে, তা বাস্তবে হবে কি না, তা বলা মুশকিল। তবে ভারতের সঙ্গে রুবল-রুপির সম্পর্ক তৈরি হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তা প্রভাব ফেলতে পারে।''
সূত্র: ডয়চে ভেলে