দেশে বছরে খুন হয় ৪০০০ জন। ঢাকায় এ সংখ্যাটা ২৫০ এর ওপরে। এ তথ্য খোদ পুলিশের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত। কিন্তু এখন অপরাধের এসব তথ্য প্রকাশ বন্ধ রয়েছে। চলতি সপ্তাহেই আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু এবং কলেজ ছাত্রী প্রীতি হত্যাকাণ্ডের পর খুন হন "গরিবের ডাক্তার” বলে পরিচিত ডেন্টিস্ট আহমেদ মাহী বুলবুল। রবিবার একই দিনে একজন গৃহবধুও খুন হন। ঢাকার বাইরেও একই দিন খুনের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
প্রশ্ন উঠেছে হঠাৎ করেই কি হত্যাসহ অপরাধ ঢাকাসহ সারাদেশে বেড়ে গেছে, নাকি ক্রমাগত বাড়ছে। আওয়ামী লীগ নেতা হত্যাকাণ্ডের কারণেই কি বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় আসছে?
এরইমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে ২০১৯ সাল থেকে হত্যাসহ অপরাধের তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যা নিয়ে পুলিশের সাবেক একজন আইজিপিসহ অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
তবে ব্যক্তি উদ্যোগে পাওয়া পুলিশের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরে ঢাকায় গড়ে ২৫০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আর সারাদেশে কম বেশি খুন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা চার হাজার।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হিসাব বলছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজধানীতে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১২টি। তার আগে জানুয়ারি মাসে নয়টি। বছর হিসেবে দেখা যায়, ২০২১ সালে ঢাকায় ১৬৬টি এবং ২০২০ সালে ২১৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীতে ২০০৮ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তিন হাজার ৩৭৫টি, গড়ে প্রতিবছর ২৪১টি।
এই তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ঢাকায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কখনো সামান্য কমে আবার আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। কোনো স্পর্শকাতর বা আলোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটলে তখন তা আলোচনায় আসে। পুলিশের তৎপরতা বাড়ে। সংবাদমাধ্যমে আসে। কিছুদিন পর আবার চুপ।
অন্যান্য অপরাধের চিত্র বিশ্লেষণ করলে একই অবস্থা দেখা যায়। তবে অপরাধের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেড়েছে। সবচেয়ে আলোচিত এবং নাগরিকদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টিকারী একটি অপরাধ হলো ছিনতাই।
২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ বছরে ছিনতাইয়ের ঘটনায় ঢাকা শহরে মামলা হয়েছে তিন হাজার হাজার ৯৫৫টি। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মামলা হয়েছে ৪৩টি।
ডিএমপির হিসাব মেনে নিলেও স্পষ্ট যে ২০১৯ সালের তুলনায় গত দুই বছরে ছিনতাই বেড়েছে। তবে ছিনতাইয়ের এই হিসাব গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ভুক্তভোগীদের বড় একটি অংশ ছিনতাই মামলা করতে থানায় যান না ভোগান্তিসহ নানা কারণে। আর নানা কারণে থানা ছিনতাইয়ের মামলা নিতে চায় না বলে অভিযোগ আছে।
সারাদেশে বছরে কত হত্যাকাণ্ড হয়? এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েব সাইটে ২০১৮ সালের পর আর কোনো পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। ২০১৯ সালের আংশিক তথ্য আছে। এর পর আর নেই। তাতে দেখা যায় ২০১৫ সালে সারাদেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে চার হাজার ৩৩৫টি। ২০১৬ সালে তিন হাজার ৫৯১টি, ২০১৭ সালে তিন হাজার ৫৪৯টি, ২১৮ সালে তিন হাজার ৮৩০টি। আর ২০১৯ সালে পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে মোট হত্যাকাণ্ডের কথা লেখা আছে ৩৫১টি। অথচ ডিএমপির হিসাব বলছে ২০১৯ সালে ঢাকা শুধু ঢাকা শহরেই ২১৯টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বছরে হত্যাসহ নানা অপরাধে প্রায় দুই লাখ মামলা হয়।
নানা পর্যায়ে কথা বলা জানা গেছে পুলিশ সদর দপ্তর ২০১৯ সাল থেকে অপরাধের তথ্য ওয়েবসাইটে দিচ্ছে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, "নতুন ওয়েবসাইট করার পর ২০১৯ সাল থেকে অপরাধের তথ্য দেওয়া বন্ধ আছে। তথ্যের প্রয়োজন হলে আমাদের কাছে চাইতে হবে। ফিজিক্যালি এসে নিতে হবে।”
এই সময়ে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধ পরিস্থিতি কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, "অপরাধ বাড়ছে না কি কমছে, ট্রেন্ড কী তা তো তথ্য বিশ্লেষণ করা ছাড়া আমি বলতে পারব না। অন্ততঃ সর্বশেষ তিনমাসের তথ্য তো লাগবে বিশ্লেষণ করতে।”
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক নূর খান মনে করেন, "অপরাধ যে বাড়ছে তা যেমন নয়, তেমনি কমছেও না। তবে এটা আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। আলোচনায় না আসলে অপরাধ নিয়ে কথাও হয় না। ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতা বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশ্যে খুন হওয়ায় এটা আলোচনায় এসেছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। তারা মনে করছেন নেতার যদি এই অবস্থা হয় তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে। সেখানে একজন নিরীহ ছাত্রীও খুন হয়েছেন। একইভাবে নৃশংসভাবে খুন হলে বা কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি খুন হলে আলোচনা হয়।”
অপরাধ না কমার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "বিচার না হওয়ায় অপরাধ কমছে না। অপরাধীর বিচার হলে আর আইনের আওতায় আনা গেলে এই পরিস্থিতি হত না। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আসছে না।”
আর সাবেক আইজিপি শহীদুল হক বলেন, "দুই দিনে ঢাকায় আওয়ামী লীগ নেতাসহ চারটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তাই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও হঠাৎ এই পরিস্থিতির কারণে অবনতি ঘটেছে। এর পিছনে নানা কারণ থাকতে পারে। কিন্তু পুলিশের কাজ হলো দ্রুত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা। সেটা করা গেলে মানুষের মনে স্বস্তি ফিরে আসবে। আওয়ামী লীগ নেতাকে যে গুলি করেছে পুলিশ তাকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করেছে। এটা ভালো। এই ধারা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।”
পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে অপরাধের তথ্য প্রকাশ বন্ধের সমালোচনা করেন সাবেক আইজিপি। তিনি বলেন,"আমরা এটা চালু করেছিলাম বাস্তব চিত্র জানাতে। এটা বন্ধ করা ঠিক হয়নি। অ্যামেরিকাসহ পৃথিবীর সবদেশেই তথ্য প্রকাশ করা হয়। আর তথ্য অধিকার আইনেও তথ্য পাওয়ার অধিকার আছে। এতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। এটা বন্ধ করায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে।‘‘
সূত্র: ডয়চে ভেলে