রাজধানীর রাস্তায় আজও কোনো বাস চলাচল করছে না, ফলে অন্য একটি রূপ পেয়েছে ঢাকা। ভয়াবহ যানজটের এ শহরে নেই একটি বাসের সঙ্গে অন্য বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ট্রাফিক সিগন্যালগুলোতেও নেই বাস, নেই যানবাহনের দীর্ঘ সারি, বাসের হেলপারের চিরচেনা হাঁকডাকও শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু যান চলাচল না থাকলেও জন চলাচল থেমে থাকেনি। এতে বেড়েছে গণ দুর্ভোগ।
জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ধর্মঘট ডেকেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। ধর্মঘটে রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যায়নি কোনো দূরপাল্লার বাস। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজন। এ অবস্থায় কয়েকগুণ বেশি ভাড়ায় মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল ও সিএনজিতে করে ঢাকা ছাড়ছেন ঘরমুখো মানুষ। যার ফলে চাপ বেড়েছে ট্রেনে।
বিপাকে অনেক যাত্রী
সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন রিফাত আক্তার। গতকাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতে না পেরে বান্ধবীর বাসায় রাত কাটান। আজ বাড়ি ফিরে যেতে গাবতলীতে যান তিনি। পরে সেখানে কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় আসেন কমলাপুর রেল স্টেশনে।
রিফাত আক্তার দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে ঢাকায় এসেছিলাম। ঢাকায় এক বান্ধবীর বাসায় ছিলাম। বাড়ি ফিরতে সকাল ৭টায় গাবতলীতে এসে দেখি দূরপাল্লার বাস বন্ধ। কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে কমলাপুর স্টেশনে এসে দুই ঘণ্টা ধরে টিকেটের আসায় লাইনে দাঁড়িয়ে আছি।
তিনি বলেন, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারে যে ভাড়ি দাবি করছে তা দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে অপেক্ষা করছি। কোননো উপায়ে আজ বাড়ি ফিরতে হবে। বৃদ্ধ মা বাড়িতে একা। তাকে দেখার মত কেউ নাই।
দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের সাথে কথা হয় আব্দুল বারেকের। তিনি কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় একটা জরুরী কাজে এসেছিলেন। টিকিট বুকিং দেয়া ছিলো। কিন্তু ধর্মঘট থাকায় বাস বন্ধ। তাই স্টেশনে টিকিটের আসায় দাঁড়িয়ে আছেন। যেকোন মূল্যে আজ বাড়ি ফিরতে হবে।
পূর্বঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে পণ্যবাহী যানের পাশাপাশি বাস বন্ধ রেখেছে মালিকরা। এদিকে বাস না পেয়ে ছুটির দিনে নিজেদের গন্তব্যে পৌঁছাতে কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে ভিড় করছে যাত্রীরা।
এদিকে ধর্মঘটের দ্বিতীয় দিন শনিবার (৬ অক্টোবর) সকালে কমলাপুর স্টেশনে হাজার খানেক যাত্রীকে টিকিটের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।
গত শুক্রবার ২৬টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে চাকরিপ্রত্যাশীদের। একই দিনে রাজধানীর সাত সরকারি কলেজের বাণিজ্য ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
শনিবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও সাত কলেজের বিজ্ঞান ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নিতেও পদে পদে ভোগান্তিতে পড়েছেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। অনেকেই যথাসময়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে না পারায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি।
বাস বন্ধ থাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল চালকরা অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছেন। তারা ১০০ টাকার ভাড়া ৫০০-৮০০ টাকা পর্যন্ত চাইছেন। অথচ সড়কের এ নৈরাজ্যের বিষয়ে নির্বিকার সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তারা রোববারের (৭ নভেম্বর) ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির বৈঠকের অপেক্ষায় রয়েছেন।
তবে জনদুর্ভোগ বিবেচনায় পরিবহন ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শুক্রবার তিনি বলেছেন, ‘রোববার বিআরটিএ-এর ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির বৈঠক হবে। সেখানে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বাস্তবভিত্তিক মূল্য সমন্বয়ের মাধ্যম জনগণের ওপর বাড়তি চাপ সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করা হবে।’
সড়কের এ সংকট সমাধানের বিআরটিএ-এর কোনো উদ্যোগ আছে কি না, জানতে চাইলে বিআরটিএ পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, ‘ডিজেলের দাম বাড়ানোর প্রেক্ষিতে ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে এ ধর্মঘট করছে বাস-ট্রাক সংশ্লিষ্টরা। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি। আগামীকাল (রোববার) আমাদের বৈঠক আছে।’
যে কারণে এই ধর্মঘট
গত ৩ অক্টোবর জ্বালানি তেলের মূল্য ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে বাড়ানো হয় কেরোসিনের দাম। ডিজেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা ও তা কার্যকরের পর থেকেই পরিবহন খাতে এর প্রভাব পড়তে শুরু করে।
এদিকে বাস মালিকদের ভাষ্য মতে, ডিজেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে চাকাসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশের দাম বেড়েছে। ২০১৯ সালে বাস ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলেও প্রজ্ঞাপন জারি করে তা কার্যকর করা হয়নি। ফলে বাস ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়ানো উচিত। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের দাবির বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সাড়া দেওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পক্ষ থেকে রোববার সভার বার্তা দেওয়া হয়েছে পরিবহন মালিক নেতাদের কাছে।
বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বরাবর চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। সংগঠনটির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ বলেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে আমি চিঠি দিয়েছি বিআরটিএ চেয়ারম্যানের কাছে। এই চিঠিতে জরুরিভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরসহ দূরপাল্লার বাস ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছে। আট বছর ধরে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। এখন তা বাড়াতে হবে। কারণ ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বেড়ে যাওয়ায় পরিবহন চালাতে গিয়ে মালিকদের ভর্তুকি দিতে হবে। এমনিতেই করোনাকালে তাদের অনেকে দেউলিয়া হয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গণপরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত নাগরিকদের ভোগান্তি তৈরি ছাড়া আর কিছুই না। তেলের মূল্য প্রত্যাহার বা স্থগিত করার কথা বললেও অন্তরালে আছে ভাড়া সমন্বয় করার কৌশল। পরিবহন মালিকদের উদ্দেশ্য ও স্বার্থ হয়ত রক্ষা হবে কিন্তু সাধারণ নাগরিকদের জীবনযাত্রা ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। আমরা তেলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল এবং পণ্য পরিবহন বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাচ্ছি।