ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২২, ০১:২১ এএম
দিবস পালনের রীতি বহু পুরনো। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের এ কালে বহু দিবস এখন বেরিয়ে এসেছে। এতেও অবশ্য সংকটের কিছু নেই। কিন্তু নতুন দিবস এসে যখন পুরনো দিবস পালনের রীতিকে বিলীণ করে দেয়, দিবসে যখন দিবসকে খেয়ে ফেলে— তখনই ভাবনা আসে নাগরিক মনে।
আজ ফাগুনের প্রথম দিন। মিষ্টি হাওয়ার ঋতু শুরুর এই দিনটি বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ। এবং এই দিন স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসও। আছে গ্লোবালাইজেশনের জোয়ার থেকে সৃষ্ট বিশ্ব ভালবাসা দিবসও। তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ এবং আকাশ সংস্কৃতির দাপটের এ কালে তরুণমনে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও বসন্তবরণের দিকেই ঝোঁক বেশি। অথচ স্বৈরাচার প্রতিরোধের যে শপথে একদা প্রাণপাত করেছিলেন দিপালী সাহা, জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, কাঞ্চনরা— তাদের কী করে ভুলে যাব আমরা?
বিদেশী সংস্কৃতি গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়েই আমাদেরকে সামনে এগুতে হবে। তবে অবশ্যই নিজেদের মৌলিক অর্জনগুলোকে বিসর্জন দিয়ে এটা করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারির দিনটিতে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের জন্য ভালোবাসার ফুল ফোটেনি। বুকের তপ্ত রক্তের রঞ্জিত হওয়া রাজপথের রক্তাক্ত গোলাপ ফুটেছিল সেদিন। সেটি ছিল স্বৈরাচার এরশাদকে প্রতিরোধ করার দিবস। সে উপলক্ষে ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের সচিবালয় অভিমুখে প্রতিরোধ মিছিল হয়েছিল। যে মিছিলের রণধ্বণি শেষ পর্যন্ত নব্বইয়ে গিয়ে এরশাদশাহীর মসনদ টলিয়ে দেয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে সুযোগ করে দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশ চলছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে। ১৯৭৫-এর ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ঘটনার মধ্যে জিয়াউর রহমান পুনরায় ক্ষমতাসীন হন। ক্যাঙ্গারু ট্রায়ালের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে আরেক সেক্টর কমান্ডার বীর কর্নেল আবু তাহেরকে। জিয়া হত্যার পর রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধসে পড়া সাত্তার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতার ক্রীড়নক জেনারেল এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করে।
এদেশের ছাত্র-জনতার শত বছরের আকাঙ্ক্ষা গণতান্ত্রিক অধিকার জনতার হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মূলত সেই ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচিতে শামিল হয়। অকুতোভয় ছাত্রসমাজ কার্জন হলের মুখে জান্তার পুলিশের ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। কিন্তু জান্তার কী সাধ্য সেই দুর্বার আন্দোলন অপ্রতিরোধ্য মিছিলকে প্রতিহত করার! শুরু হয় টিয়ার গ্যাস, জলকামান, অবশেষে নির্বিচারে গুলি। লুটিয়ে পড়েন অসংখ্য শহীদ যাদের লাশ গুম করা হয়েছিল পরবর্তীতে। এর প্রতিবাদে ১৫ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সামরিক শাসনকে মোকাবিলা করার জন্য তখনো তেমনভাবে প্রস্তুত ছিল না। এরপরও ছাত্র-জনতার আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়। সে কারণেই আমরা ১৪ ফেব্রুয়ারি স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হতে থাকে।
এ কাঙ্ক্ষিত আন্দোলন অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৯০ সালের ৪ ডিসেম্বর স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিজয় সূচনা করে। ৬ ডিসেম্বর এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হয় নব্বইয়ের অভ্যুত্থানে পরাজিত শক্তির ভিন্নরূপ।
ঘটনাক্রমে স্বৈরচার প্রতিরোধ দিবসকে গৌণ করে ১৯৯৩ সালের দিকেই দেশে প্রচলিত হতে শুরু করে ‘ভালোবাসা দিবস’।
নতুন প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস পালনে ‘না’ নেই। বসন্তের এদিনে বাগানে ফুটবে নানা রঙের কত শত ফুল। কত ফুল শোভা পাবে রমণীর নোটন খোঁপায়। প্রিয় মানুষের সঙ্গে হাতে হাত রেখে চলবে বর্ণিল জুটি। এ দিনে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি ভালোবাসাময় পৃথিবী উপহারের প্রতিজ্ঞা থাকুক। সাথে থাকুক স্বৈরাচার সরকারের হাতে নিহত শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার অর্ঘও। তাদের প্রতিও যেন নিবেদিত হয় প্রজন্মের হাতের ফুল। একদা ১৪ ফেব্রুয়ারিতে যাদের নিঃশ্বাস স্বৈরাচারের বুলেটে বেয়নেটে দেহত্যাগ করেছিল, তাদের আত্মা তবেই পাবে শান্তি।