এহসান গ্রুপ ও ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের টাকা আত্মস্যাৎ করে যেভাবে মানুষকে সর্বশান্ত করেছে, তাতে ক্ষোভ প্রকাশ করে আদালত বলেন, ‘সরকার তো ব্যবস্থা নিচ্ছে। কখন? যখন আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম, তখন। আমার রেমিডিটা কোথায়? আমার টাকাটা নিয়ে গেল, আমি দ্বারে দ্বারে ঘুরব? তিনি থানায় যাবেন, জেলখনায় যাবেন ভাত খেয়ে ঘুমাবেন। কিন্তু আমার টাকাটা যে নিয়ে গেল, সেই টাকার কী হবে?’
সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) সারা দেশে চড়া সুদে ঋণদাতা মহাজনদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানিতে আদালত এ মন্তব্য করেন। বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমান ও বিচারপতি মো. জাকির হোসেন সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে রিটের ওপর শুনানি হয়।
এসময় আদালত আরও বলেন, ‘নিবন্ধন নেই অথচ হাজার কোটি টাকা নিয়ে চলে গেল। যুবক কত সালে কত টাকা নিয়ে গেল। এই যে টাকা নিয়ে গেল—আমাদের রাস্তাটা খোলা কেন?’
শুনানিকালে প্রশ্ন রেখে আদালত বলেন, ‘আমার বাড়ি খোলা কেন? আমার বাড়ি অরক্ষিত কেন? দেশের মানুষ সব দরজা–জানালা বন্ধ করে শান্তিতে ঘুমাবে। আমার ঘর কেন অরক্ষিত? আমার ঘরের দরজাগুলো কেন খোলা? মানুষ কেন টাকাগুলো লুট করে নিয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে? এই দরজাগুলো খোলা কেন? কাদের দায়িত্ব দরজাগুলো বন্ধ করার? এগুলো পরীক্ষা করতে চাই, দেখে–শুনে আদেশ দেওয়া হবে।’ পরে আদালত ২৭ সেপ্টেম্বর আদেশের জন্য দিন রেখেছেন।
এর আগে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর উস সাদিক বলেন, সরকার যে ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। এহসান গ্রুপের মালিক ও ইভ্যালির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর উস সাদিক বলেন, মামলা করার পর চোর ধরা হচ্ছে। চুরির বিষয়ে আইন আছে। চুরি তো ঠেকানো যাচ্ছে না, চুরি তো হচ্ছে। প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে।
আদালত প্রশ্ন রেখে বলেন, সরকারের অভিপ্রায় কী? এ দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার, তাদের আইনের শাসন—সবকিছু সুপ্রতিষ্ঠিত করতে চায় সরকার।
এর আগে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অনির্দিষ্ট বিষয়বস্তুর ওপর রুল হতে পারে না। কার বিরুদ্ধে অভিযোগ বা কারা এ কাজ (চড়া সুদে অর্থ দিচ্ছেন) করছেন, তাদের নাম সুনির্দিষ্ট করে দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে পারেন।
সারা দেশে চড়া সুদে ঋণদাতা মহাজনদের চিহ্নিত করার নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক ৭ সেপ্টেম্বর ওই রিটটি করেন। আদালতে রিটের পক্ষে তিনি নিজে শুনানিতে অংশ নেন। শুনানিতে সৈয়দ সায়েদুল হক বলেন, দেশে ৬১টি তফসিলি ব্যাংক ও তফসিলভুক্ত নয় ৫টিসহ ৬৬টি ব্যাংক আছে, যারা ব্যাংকিং ব্যবসা করছে। ৪৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে।
‘লোপাট ২১ হাজার কোটি টাকা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে সৈয়দ সায়েদুল হক বলেন, মানুষের টাকা আত্মসাতের পরিমাণ কোটি টাকায়। ২০০৬ সালে যুবক নিয়ে গেছে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এদের ঋণ বিতরণের কোনো লাইসেন্স ছিল না। ২০১১ সালে ৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে ইউনিপেটুইউ।
আদালত বলেন, ইউনিপেটুইউ কি অনিবন্ধিত? তখন সৈয়দ সায়েদুল হক বলেন, অনিবন্ধিত। এরা সোসাইটি হিসেবে লাইসেন্স নেয়। আদালত বলেন, কোন কর্তৃপক্ষ এসব নিয়ন্ত্রণ করে?
তখন সৈয়দ সায়েদুল হক বলেন, মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোকে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। তারা ঋণ বিতরণ করতে পারে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে চলতি বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ৭৪৬টি মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠান আছে। বেআইনি কার্যক্রমের জন্য ১৩৪টির লাইসেন্স বাতিল করা হয়।
আদালত বলেন, যাদের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, তাদের কার্যক্রম কি চলছে? সৈয়দ সায়েদুল হক বলেন, এ তথ্য নেই। এ তথ্য আদালতে আসুক।
আদালতের প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ সায়েদুল হক বলেন, ঋণ বিরতণ কার্যক্রম চালাতে হলে মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি, ব্যাংকিংয়ের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইসেন্স নিতে হবে। এই তিনটির বাইরে তো সুযোগ নেই। সোসাইটির রেজিস্ট্রেশন নিয়ে সমাজের সেবা করতে বলে অনেক সংগঠন ঋণের ব্যবসা শুরু করে দেয়।
রিটে মহাজনদের উচ্চ হারে অনানুষ্ঠানিক ঋণ প্রদান নিষিদ্ধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে। রিটের আবেদনে দেখা যায়, প্রতিবেদনে উল্লিখিত চড়া সুদে অনানুষ্ঠানিকভাবে মহাজনদের ঋণ দেওয়া রোধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা/ব্যর্থতা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং সারা দেশে চড়া সুদে ঋণ বিতরণ কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না—সে বিষয়েও রুল চাওয়া হয়েছে। রুল হলে তা বিচারাধীন অবস্থায় চড়া সুদে ঋণদাতা সব মহাজনকে চিহ্নিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনাও চাওয়া হয়েছে।