জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কাজী অনিরুদ্ধের স্ত্রী কল্যাণী কাজী ৮৭ বছর বয়সে আজ ভোরবেলায় কলকাতায় মারা গেছেন। তিনি ক্যান্সারের সাথে লড়ছিলেন। বিদ্রোহী কবি নজরুল ও তাঁর পরিবার নিয়ে বিপুল আগ্রহ ও ভালোবাসা রয়েছে দুই বাংলার পাঠকদের। এ বিষয়টি মাথায় রেখে জাতীয় কবির পরিবারের বংশধরেরা কে কোথায় আছেন, সেটি তুলে ধরা হলো দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের পাঠকদের জন্য।
বিদ্রোহী কবির তিন ছেলে তাঁর আগেই মারা গিয়েছিলেন, শুধু তৃতীয় সন্তান কাজী সব্যসাচী মারা গিয়েছিলেন বাবার পরে। তাদের বংশধরেরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন তারা।
জীবনের শেষবেলায় প্রেম ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
প্রেম ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুল মানুষ হিসেবে ছিলেন সকল জাত-পাত, সাম্প্রদায়িকার উর্ধ্বে। মানুষে মানুষে ধর্মীয় কারণে যে ভেদাভেদ সেটাকে তিনি জীবনে খুব একটা পাত্তা দেননি। তাঁর সৃষ্টি কর্মেও ধর্মীয় পরিচয়কে বারবার তুচ্ছ জ্ঞান করে মানবতার জয়গান গাইতে দেখা গেছে। সাহিত্যের বাইরে বাস্তব জীবনেও তিনি তার প্রমাণ রেখে গেছেন।
নজরুল প্রথম বিয়ে করেন ১৯২৪ সালে। তাঁর সাথে বিয়ে হয় কুমিল্লার কান্দির পাড়ের কন্যা আশালতা সেনগুপ্তের। বিয়ের আগে বা পরে স্ত্রীকে নজরুল ইসলাম ধর্মে অন্তরিত করেননি। তাই যে- ইসলামি প্রথা মেনে মুসলমানের সাথে মুসলমানের বিয়ে হয় নজরুলের ক্ষেত্রে সেই প্রচলিত রীতি পালন করা হয়নি। ‘ইসলামী মতে’ এক বৈবাহিক চুক্তি অনুসারে নজরুলের বিয়ে হয়। তাতে ধর্ম বদলের দরকার পড়েনি।
তারুণ্যে কবি কাজী নজরুল। ছবি: সংগৃহীত
আশালতার বিধবা মা গিরিবালা দেবী মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। ১৯২৪ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতায় মেয়ের বিয়ে দেন নজরুলের সাথে। মুসলমান পরিবারে জন্ম নেওয়া প্রায় বাউণ্ডুলে চাকরিহীন, বাসস্থানহীন, ব্রিটিশ সরকারের কুনজরে পড়ে জেলখাটা এক কবির সাথে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিতে তাঁর সংস্কারে বাধেনি। নজরুলের প্রতি কতটা গভীর স্নেহ থাকলে এমন করে সংস্কারের পুরোনো শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলা যায় বিধবা গিরিবালা তাঁর বড় উদাহরণ। আর এ ঘটনা ঘটেছে সেই বাঙালী সমাজের সেই কালে যখন ধর্ম নিয়ে, জাত-পাত নিয়ে দাঙ্গা নতুন করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে ভারতীয় রাজনীতির প্রশ্রয়েই।
বিয়ের পর আশালতার ঘরে নজরুলের চার সন্তান জন্ম নেয়। সবাই ছিলেন ছেলে এবং এর মাঝে প্রথম দুই জনই খুব অল্প বয়সে মারা যান। সন্তানদের নাম যথাক্রমে:
১. কাজী কৃষ্ণ মুহাম্মদ,
২. কাজী অরিন্দম খালেদ (বুলবুল),
৩. কাজী সব্যসাচী এবং
৪. কাজী অনিরুদ্ধ।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে কাজী নজরুল ইসলাম (১৯২৯ সাল)। ছবি: নজরুল ইন্সটিটিউট
প্রথম সন্তান কৃষ্ণ মুহাম্মদ জন্মের কয়েক মাস পরেই মারা যান। দ্বিতীয় সন্তান বুলবুল বেঁচে ছিলেন মাত্র ৩ - ৪ বছর। বুলবুল মারা যাওয়ার পর সন্তান হারানোর শোকে বিহ্ববল বাবা নিচের গানটি লিখেছিলেন:
‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি; করুণ চোখে চেয়ে আছে সাঁঝের ঝরা ফুলগুলি’।
তৃতীয় সন্তান কাজী সব্যসাচী
সব্যসাচী ছিলেন ভারতের একজন নামকরা আবৃত্তিকার। কাজী সব্যসাচী কাজী নজরুল ইসলামের জীবিত সন্তানদের মধ্যে বড় ছিলেন। ১৯৬০-৭০ এর দশকে তিনি আবৃত্তিকার হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেন। ১৯৬৬ সালে তিনি তাঁর পিতার বিখ্যাত “বিদ্রোহী” কবিতাটির আবৃত্তি প্রথম রেকর্ড করেন। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকার “কাজী সব্যসাচী স্মৃতি পুরস্কার” নামে আবৃত্তিতে পুরস্কার দিয়ে আসছে। একজন বাংলাদেশী ও একজন ভারতীয়কে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
কলকাতার রাজভবনে কবিপুত্র কাজী সব্যসাচী, কাজী অনিরুদ্ধ, কল্যাণী কাজীর সাথে শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
সব্যসাচী ও উমার সংসারে ছিলো তিন সন্তান।
পুত্রবধু উমা কাজী ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন কবিকে। ছবি: সংগৃহীত
১. সবার বড় মেয়ে খিলখিল কাজী, একজন নজরুল সংগীত শিল্পী ও সাংগঠক, কাজী নজরুল ইসলামের গান গুলোর মূল স্বরলিপি সংরক্ষণে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে ২০১৩ সালে নজরুল ইন্সটিটিউট নজরুল পদকে ভূষিত করে।
২. তারপর দ্বিতীয় মেয়ে মিষ্টি কাজী এবং
৩. সবার ছোট ছেলে বাবুল কাজী।
কাজী সব্যসাচী ১৯৭৯ সালের ২ মার্চ কোলকাতায় মারা যান। আর উমা কাজী মারা যান এ বছর ১৫ জানুয়ারি।
কাজী অনিরুদ্ধ
কবির চতুর্থ সন্তান, জীবিতদের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন। প্রখ্যাত গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ। তিনি কবির সৃষ্ট অমর সুর সম্পদ সংরক্ষণের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। নজরুলের দুষ্প্রাপ্য লুপ্ত, অর্ধলুপ্ত গানের সুর উদ্ধার, স্বরলিপি প্রণয়ন ও প্রকাশের মাধ্যমে কবির সৃষ্টিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করেন। কাজী অনিরুদ্ধ'র সহধর্মিণীর নাম কল্যাণী কাজী। কল্যাণী কাজী নিজেও একজন সঙ্গীত শিল্পী। অনিরুদ্ধের সঙ্গে তার বিয়ে হয় ১৯৫২ সালে। তিনি লেখালেখিও করতেন। তাদেরও তিন সন্তান। যথাক্রমে,
১. বড় ছেলে কাজী অনির্বাণ,
২. দ্বিতীয় ছেলে কাজী অরিন্দম (সূবর্ণ) এবং
৩. সবার ছোট মেয়ে কাজী অনিন্দিতা।
বড় ছেলে কাজী অনির্বাণ নিজে একজন পেইন্টার। কলকাতায় একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা পরিচালনা করেন তিনি। অনির্বাণের স্ত্রী সোমা মুখার্জি। তাদের দুই সন্তান,
১. অংকন এবং
২. ঐশ্বরিয়া।
দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম (সূবর্ণ) একজন গিটার বাদক। তিনি কলকাতায় থাকেন। অরিন্দমের স্ত্রী সুপর্ণা ভৌমিক। তাদের দুই সন্তান,
১. অভিপ্সা ও
২. অনুরাগ।
সব্যসাচী, অনিরুদ্ধর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত
কাজী অনিরুদ্ধ’র ছোট মেয়ে অনিন্দিতা একাধারে নজরুল ও রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী। সাংবাদিকতা দিয়ে পেশা জীবনের শুরু হলেও বর্তমানে ভারতের টিভি চ্যানেল ‘তারা মিউজিক'-এর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান 'আজ সকালের আমন্ত্রণ'-এর উপস্থাপনা করেন। অনিরুদ্ধ পরিবার কোলকাতায় থাকেন।
কবির জীবদ্দশাতেই ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৪৩ বছর বয়সে কবির কনিষ্ঠ পুত্র অনিরুদ্ধ কোলকাতায় মারা যান। শুধু কাজী সব্যসাচী বাবা নজরুল ইসলামের মৃত্যুর পর ১৯৭৯ সালে মারা যান।
তথ্যসূত্র:
১. কবি নজরুলের প্রেম ও পারিবারিক জীবনের কিছু কথা: জিয়াদ আলি
২. বেড়ে উঠেছি নজরুল পরিবারে: খিলখিল কাজী
৩. ঢাকায় নজরুলের তিন প্রজন্ম: তাসলিমা তামান্না