ব্ল্যাক মিরর: ভবিষ্যতের পৃথিবী দেখার ‘টাইম মেশিন’

তিথি চক্রবর্তী

জানুয়ারি ২১, ২০২৪, ০৬:৪৮ পিএম

ব্ল্যাক মিরর: ভবিষ্যতের পৃথিবী দেখার ‘টাইম মেশিন’

অনলাইনের দুনিয়াটা বেশ মজার। সবাই প্রায় একই রকম জিনিস জানছে, শেয়ার করছে, কথা বলছে। কিন্তু সবকিছুই হচ্ছে দূর থেকে। প্রযুক্তির সাথে মানুষের এই যে সম্পর্ক, সেটি নানাভাবে তুলে ধরা হয়েছে ব্রিটিশ অ্যান্থলজি টিভি সিরিজ ‘ব্ল্যাক মিরর’ এ।

মজার ব্যাপার হলো, ২০১১ সালে শুরু হওয়া এবং এখন পর্যন্ত মাত্র ২২টি পর্ব প্রচারিত হওয়া ব্ল্যাক মিরর সিরিজটির বিভিন্ন পর্বের ভবিষ্যদ্বাণী এরই মধ্যে বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে, যা এক কথায় অবিশ্বাস্য।

চলুন দেখে নিই ব্ল্যাক মিররের এ ধরনের পাঁচটি ভবিষ্যদ্বাণী, যা ইতোমধ্যেই বাস্তবে রূপান্তরিত হয়েছে।

এন্টায়ার হিস্ট্রি অব ইউ : স্যামসাংয়ের স্মার্ট লেন্স

ব্ল্যাক মিররের প্রথম সিজনে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল এর তৃতীয় এপিসোডটি। দ্য এন্টায়ার হিস্ট্রি অব ইউ শিরোনামের ঐ এপিসোডে নিকট ভবিষ্যতের একটি চিত্র আঁকা হয়, যেখানে সবার মস্তিষ্কে একটি করে মেমোরি ইমপ্ল্যান্ট বসানো থাকে। ঐ মেমোরি ইমপ্ল্যান্টটি সারা দিনে মানুষের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া প্রতিটি মুহূর্তের ভিডিও রেকর্ড করে রাখতে পারে। পরে যেকোনো সময় চোখের লেন্সের মধ্য দিয়ে কিংবা টিভির স্ক্রিনে প্রজেকশনের মাধ্যমে যেকোনো ঘটনা প্লে-ব্যাক করা যায়।

২০১৪ সালে স্যামসাং ঠিক এরকমই একটি প্রযুক্তির প্যাটেন্ট করে। প্যাটেন্টের বিবরণ অনুযায়ী তারা এমন একধরনের স্মার্ট লেন্স নির্মাণ করবে, যার মাধ্যমে ব্যবহারকারী চোখের ইশারায় তার সামনের দৃশ্যের ছবি তুলে ফেলতে পারবে।

বি রাইট ব্যাক : মৃত ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনা

ব্ল্যাক মিররের দ্বিতীয় সিজনের প্রথম এপিসোডটির শিরোনাম ছিল বি রাইট ব্যাক। এই পর্বে দেখানো হয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ঐ প্রযুক্তির মাধ্যমে যেকোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পরেও তার সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট, পুরাতন ছবি এবং ভিডিও ব্যবহার করে হুবহু তার মতো একটি ভার্চুয়াল চরিত্র সৃষ্টি করা যায়, যে ঠিক তার গলার স্বরে এবং তার স্টাইল অনুযায়ীই কথা বলে।

সে সময় অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটি এখন মোটেও আর সায়েন্স ফিকশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। পর্বটি প্রচারের মাত্র এক বছর পরেই এক পর্তুগিজ ডেভেলপার হেনরিক হোর্গে ইটার-নাইন (ETER9) নামে একটি সোশ্যাল মিডিয়া চালু করেন (eter9.com)। এই সাইটে অ্যাকাউন্ট চালু করে নিয়মিত পোস্ট দিতে থাকলে সাইটটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ব্যবহারকারীর পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে তার চরিত্র সম্পর্কে ধারণা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে ব্যবহারকারীর মৃত্যু ঘটলেও তার পরিবর্তে তার মতো করেই বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে যেতে থাকে!

নোজডাইভ : চীনের সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম

২০১৬ সালে নেটফ্লিক্সের হাতে যাওয়ার পর ব্ল্যাক মিররের তৃতীয় সীজনের প্রথম এপিসোডটির শিরোনাম ছিল ‘নোজডাইভ’। এই পর্বে এমন এক সমাজ ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি অন্য কারো সাথে মিথষ্ক্রিয়ার পর মোবাইল ফোনের একটি অ্যাপের মাধ্যমে তাকে ৫ এর মধ্যে যতো খুশি রেটিং দিতে পারে।

শুনতে সুদূর ভবিষ্যতের কল্পকাহিনী কিংবা অবাস্তব মনে হলেও চীন ইতোমধ্যেই সোশ্যাল ক্রেডিট সিস্টেম নিয়ে কাজ শুরু করে দিয়েছে। তারা প্রতিটি নাগরিককে এই সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে একাধিক সিটি কাউন্সিল এবং টেক কোম্পানির সাথে কাজ করে যাচ্ছে।

ওয়াল্ডো মোমেন্ট : ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়া

২০১৩ সালে প্রচারিত হয় ব্ল্যাক মিরেরর দ্বিতীয় সীজনের তৃতীয় এপিসোড ‘দ্য ওয়াল্ডো মোমেন্ট’। ওয়াল্ডো হচ্ছে মূলত একটি অ্যানিমেটেড কার্টুন চরিত্র। জেমি সল্টার নামে এক ব্যর্থ কমেডিয়ান মোশন ক্যাপচার প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্দার আড়ালে থেকে একটি অ্যানিমেটেড ভালুকের চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

ওয়াল্ডো অভিনীত নতুন একটি শো’র মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে টিভি প্রযোজকদের পরামর্শে জেমি সল্টার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওয়াল্ডো চরিত্রটিকে স্থানীয় নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করান। তাকে অবাক করে দিয়ে প্রচলিত রাজনীতির প্রতি বিমুখ ভোটারদের কাছে ওয়াল্ডোর জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এক পর্যায়ে নির্বাচনে তার জয়ী হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। শেষপর্যন্ত অবশ্য ওয়াল্ডো দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে।

২০১৬ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করেন, তখন অনেকেই তার সাথে ওয়াল্ডো মোমেন্টের অস্বাভাবিক মিল খুঁজে পান। কারণ ট্রাম্প নিজেও একসময় রিয়েলিটি টিভি ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার নির্বাচনী প্রচারণাকেও প্রথম দিকে সবাই কৌতুক হিসেবে নিয়েছিল। এবং তার কথাবার্তা, আচার-আচরণের সাথেও সাধারণ মানুষের তুলনায় কার্টুন চরিত্রেরই সাদৃশ্য বেশি।

ন্যাশনাল অ্যান্থেম : ডেভিড ক্যামেরনের ‘পিগগেট’

ব্ল্যাক মিররের প্রথম সিজনের প্রথম এপিসোডটির শিরোনাম ছিল ‘দ্য ন্যাশনাল অ্যান্থেম’। এই পর্বে যুক্তরাজ্যের অপহৃত রাজকন্যাকে মুক্ত করার জন্য অপহরণকারীদের দাবি অনুযায়ী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীকে ন্যাশনাল টেলিভিশনে শুকরের সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হতে হয়।

২০১৪ সালে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলিমেইল রিপোর্ট করে, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন একটি সিক্রেট সোসাইটির সদস্য ছিলেন। এবং ঐ সোসাইটির একটি অনুষ্ঠানে তিনি নিজের শরীরের একটি স্পর্শকাতর অঙ্গ একটি মৃত শুকরের মুখের ভেতর প্রবেশ করিয়েছিলেন!

ব্ল্যাক মিরর আসলে কোনো সময় কাটানোর হালকা সিরিজ না। মানুষের মনের গভীরে সন্তপর্ণে জায়গা করে নেয় এই সিরিজটি। তাই দেখবেন একদিন আপনি নিজের অজান্তেই এর কাহিনীগুলো চিন্তা করে হারিয়ে যাবেন অতলে। খুব সুন্দর একটা সময় কাটানোর জন্য তাই এর থেকে ভালো আর কিছু হতেই পারে না।

Link copied!