ডিসেম্বর ১৫, ২০২১, ১১:৫৬ এএম
দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিলো। যুদ্ধে অতুলনীয় সাহস এবং আত্মত্যাগের প্রদর্শনের মাধ্যমে এ জাতি ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। দেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধে এই আত্মত্যাগ এবং অপরিসীম বীরত্বের নিদর্শনস্বরূপ সাত যোদ্ধাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। বিজয়ের এই মাসে আমরা নিয়ে এসেছি এই সাত যোদ্ধার গল্প। প্রথম পর্বে আজ থাকছে বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর এবং বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের কথা।
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালাচ্ছিলো। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীতে কর্মরত মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর তার আরও তিন সহকর্মীসহ গোপনে কর্মস্থল ত্যাগ করে দুর্গম পথ পারি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন।
যুদ্ধে যোগদানের পর তাকে ৭ নং সেক্টরের মেহেদিপুর (মালদহ জেলায়) সাবসেক্টরের কমান্ডার হিসেবে তাকে নিয়োগ করা হয়। এরপর থেকে বেশ কয়েকটি অভিযানে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর অপরিসীম বীরত্ব প্রদর্শন করেন। ফলস্বরূপ যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে চাপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের জন্য তাকে একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয়া হয়।
চাপাইনবাবগঞ্জ শহর নিজেদের দখলে রাখার জন্য মহানন্দা নদীর তীরে পাকিস্তানী বাহিনী তিন কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বাঙ্কার নির্মাণ করে রেখেছিলো। মহিউদ্দিন তার সাথে মুক্তিযোদ্ধার দল নিয়ে শহরের পশ্চিমে বারঘরিয়া নামক স্থানে ১০ ডিসেম্বর অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৩ ডিসেম্বর তিনি এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা সহ নৌকাযোগে মহানন্দা নদী পার হন এবং অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর বেশ কয়েকটি বাঙ্কার দখল করে নেন। পাকিস্তানী বাহিনী তখন পশ্চাদপসরণ করে অবস্থান নেয় এবং মাত্র একটি অবস্থান থেকে মেশিনগান থেকে অনবরত গুলিবর্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের শহরাভিমুখে অগ্রযাত্রা ঠেকিয়ে রাখে। শত্রুর মেশিনগান ধ্বংস করার জন্য হাতে গ্রেনেড নিয়ে জীবন বাজি রেখে মহিউদ্দিন গোপনে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসেন। হামাগুড়ি দিয়ে দ্রুত মেশিনগানবাহী বাড়িটির দিকে এগিয়ে তিনি মেশিনগান বরাবর গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। গ্রেনেড বিস্ফোরণে মেশিনগানের স্থলটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হলেও মুখোমুখি সংঘর্ষরত অবস্থায় অকস্মাৎ শত্রুর একটি গুলি তাঁর কপালে বিদ্ধ হয়, এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
তার হতাশ না হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা সন্ধ্যার দিকে শত্রুর অবস্থানের ওপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা শেষপর্যন্ত রাতের অন্ধকারে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভোর রাতে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃতদেহ উদ্ধার করে তাঁকে ছোট সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্ম নেন। সেখানেই উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার্থে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মানসূচক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সিপাহি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর মাত্র এক মাসের কিছু বেশি সময় পার হয়েছিলো হামিদুর রহমানের। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনীর আক্রমণ শুরু হলে তিনি সেনানিবাস ত্যাগ করে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। পরে তিনি বর্তমান মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে ধলই নামক স্থানে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন।
ঐ অঞ্চলে ধলই সীমান্তে পাকসেনাদের ঘাঁটি ছিলো সামরিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা ঘাঁটিটি দখলের পরিকল্পনা করে। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে কোম্পানিকে এ দায়িত্ব দেয়া হয় হামিদুর রহমান সে কোম্পানির সদস্য ছিলেন।
২৪ অক্টোবর রাত থেকে ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই ঘাঁটির দখল নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকবাহিনীর মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষ চলে। ২৮ অক্টোবরের পূর্ব রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনটি প্লাটুন অতি সতর্কতার সাথে পাকসেনাদের ঘাঁটি অভিমুখে অগ্রসর হয়। শত্রুর ঘাঁটির কাছাকাছি অবস্থানে এসে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণের উদ্যোগ নিলে অকস্মাৎ একটি মাইন বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের শব্দে শত্রুপক্ষ সচকিত হয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। একদিক থেকে শত্রুপক্ষের এল.এম.জির গুলবর্ষণের ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।
এ সময় হামিদুর রহমান শত্রুর এল.এম.জি পোস্ট ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তার দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রেনেড নিয়ে রাতের অন্ধকারে হামাগুড়ি দিয়ে শত্রুর এল.এম.জি পোস্টের দিকে অগ্রসর হন এবং শেষ প্রহরে গ্রেনেড ছুড়ে দুই এল.এম.জি চালককে হত্যা করেন। এল.এম.জি থেকে গুলিবর্ষণ সাথে সাথে বন্ধ হলেও শত্রুপক্ষের গুলিবিদ্ধ হয়ে হামিদুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন।
এল.এম.জির গুলিবর্ষণ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর ঘাঁটি দখল করেন। তারা হামিদুর রহমানের মৃতদেহ উদ্ধার করেন। প্রথমে ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাসায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। ধলই সীমান্তে তাঁর শাহাদাত স্থলে পরবর্তী সময়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে তার দেহাবশেষ ঢাকায় এনে সমাহিত করা হয়।
হামিদুর রহমান পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার চাপড়া থানার ডুমুরিয়া গ্রামে ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ভারত বিভাগের (১৯৪৭) পর তাঁদের পরিবার পূর্ববঙ্গে এসে খুলনা জেলার খালিশপুরের ঘরোদায় স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। হামিদুর রহমান খালিশপুর প্রাইমারি স্কুলে এবং পরে স্থানীয় একটি নৈশ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ হামিদুর রহমানকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।