ছিলেন পিয়ন (ভৃত্য)। সেখান থেকে রাতারাতি ৪০০ কোটি টাকার মালিক। গতকাল রোববার চীন সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের বিষয়টি জানান।
দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন জানায়, ওই পিয়নের নাম জাহাঙ্গীর আলম ওরফে ‘পানি জাহাঙ্গীর’। তার নিবাস নোয়াখালীর চাটখিল থানাধীন খিলপাড়া ইউনিয়নে। বাবা মৃত রহমত উল্ল্যাহ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলে থাকার সময়ও জাহাঙ্গীর আলম তার বাসভবন ‘সুধা সদনের’ ব্যক্তিগত স্টাফ বা কর্মচারী হিসেবে কাজ করেছেন। তখন বিভিন্ন প্রোগ্রামে শেখ হাসিনার জন্য বাসা থেকে যে খাবার পানি নেওয়া হতো, সেটা বহন করতেন রাতারাতি ৪০০ কোটির মালিক বনে যাওয়া এই জাহাঙ্গীর। এজন্যই তিনি ‘পানি জাহাঙ্গীর’ নামেও সমধিক পরিচিত। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলে তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন।
বাংলা ট্রিবিউনের ব্যাপক অনুসন্ধানের পর গণমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে, চাটখিলের সেই জাহাঙ্গীর প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে কাজ করলেও পরিচয় দিতেন ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয় দিয়ে নানা তদবির করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। নোয়াখালী ও রাজধানী ঢাকায় বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন তিনি। এখানেই শেষ নয়, ‘প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী’ পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তি লাইসেন্সকৃত পিস্তল সঙ্গে নিয়ে চলাফেরা করতেন।
সূত্র জানায়, কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের পর রীতিমতো রাজনৈতিক মাঠে নেমে যান পিয়ন জাহাঙ্গীর। চাটখিল উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতির পদও বাগিয়ে নিয়েছেন। পাশাপাশি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। পরে প্রতীক হিসেবে নৌকা না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। তবে সেই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। অভিযোগ রয়েছে, নোয়াখালী-১ আসনের নৌকা প্রার্থী এইচ এম ইব্রাহীমের বিরোধিতা করে তাকে হারানোর পাঁয়তারা করেছেন তিনি। ‘প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী’ পরিচয় দিয়ে এই কাজ করাতে গিয়েই তার বিরুদ্ধে প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
গণমাধ্যমের খবরে এসেছে, রাজধানী ঢাকায় একাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছেন জাহাঙ্গীর। ধানমন্ডিতে স্ত্রীর নামে কিনেছেন আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া নোয়াখালীর মাইজদী শহরের হরি নারায়ণপুরে তার আট তলা একটি বাড়ি রয়েছে। সেটাও তার স্ত্রীর নামে। এমপি হওয়ার জন্য নোয়াখালীতে মোটা অঙ্কের টাকা ব্যয় করেছেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বিশাল বহর নিয়ে সভা-সমাবেশ করতেন তিনি। এসব সভা-সমাবেশের জন্য খরচ করেছেন লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সরকারের একাধিক প্রভাবশালী মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে নিজের এলাকায় দাওয়াত করে নিয়ে যেতেন তিনি। যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন হেলিকপ্টার।
এখানেই শেষ নয়, অনুসন্ধানে উঠে এসেছে যে ধানমন্ডিতে আলিশান ফ্ল্যাট ছাড়া রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও নিউমার্কেটে তার রয়েছে দুটি দোকান। রাজধানীর মিরপুরে সাততলাবিশিষ্ট একটি ভবন ও দুটি ফ্ল্যাটও রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যক্তিগত কর্মচারীর। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের হলফনামায় জাহাঙ্গীর কৃষিখাত থেকে প্রতি বছর তার আয় ৪ লাখ টাকা, বাড়ি ও দোকান ভাড়া থেকে সাড়ে ১১ লাখ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে ৯ লাখ টাকা, চাকরি থেকে ৬ লাখ টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা আয়ের তথ্য প্রকাশ করেছেন। হলফনামার হিসাব অনুযায়ী বছরে প্রায় ৫০ লাখ টাকা আয়ের কথা জানান তিনি।
হলফনামার তথ্য অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরের নিজের নামে আড়াই কোটি টাকা ও স্ত্রীর নামে ব্যাংকে প্রায় সোয়া ১ কোটি টাকা ছিল। ডিপিএস ছিল পৌনে ৩ লাখ টাকা, এফডিআর ছিল সোয়া ১ কোটি টাকা। স্ত্রীর নামে কিনেছেন গাড়ি। বিভিন্ন কোম্পানিতে রয়েছে কোটি টাকার শেয়ারও। এ ছাড়া একটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানে ৬ কোটি টাকার বিনিয়োগও করেছেন তিনি।
স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পিয়ন হিসেবে কাজ করার সময় ব্যক্তিগত পরিচয় দিয়ে তদবির, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম করে বেড়ান জাহাঙ্গীর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচয় ব্যবহার করে গাজীপুরের ইপিজেড এলাকার ঝুট ব্যবসাও নিয়ন্ত্রণে ছিল তার।
বিপুল সম্পদের উৎস সম্বন্ধে জাহাঙ্গীর আলমের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। একাধিকবার ফোন করেও পাননি দেশের শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম বাংলা ট্রিবিউন। গতকাল রোববার একাধিক সূত্র জানায়, বিকেল পর্যন্ত তার মোবাইল খোলা ছিল। প্রজ্ঞাপনের পর মোবাইল বন্ধ করে আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, জাহাঙ্গীর উপলব্ধি করেছেন যে যেকোনও সময় তাকে গ্রেপ্তারের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই যেভাবেই হোক, যেকোনও উপায়ে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন।