অর্থনৈতিক সংকট : কর ছাড়ের শতাধিক আবদার ব্যবসায়ীদের

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

এপ্রিল ১২, ২০২৩, ১০:০০ পিএম

অর্থনৈতিক সংকট : কর ছাড়ের শতাধিক আবদার ব্যবসায়ীদের

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট, ডলারের অতিমূল্যের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এসময়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। তবে বেসরকারি খাতের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা ঢালাও করছাড়ের শতাধিক প্রস্তাব দিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর)। বৃহস্পতিবার এফবিসিসিআই এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে পরামর্শক কমিটির ৪৩তম সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় এই সব দাবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও হবে।

১২৮ টি করছাড়ের প্রস্তাব

আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক খাতের অন্তত ১২৮টি করছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে এনবিআরকে। এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্বে ঢাকা চেম্বার, মেট্রোপলিটন চেম্বার, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, চট্টগ্রাম চেম্বার, বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ, ফরেন চেম্বার, রিহ্যাব, ই-ক্যাব, ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনসহ দেশসেরা ২৮টি ব্যবসায়িক সংগঠনগুলো এই প্রস্তাব দিয়েছে।

কর ছাড়ের ব্যাপারে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, করহার বাড়ালেই যে কর বেশি আসবে এমনটা নয়। বেশি করহারের কারনে অনেক ব্যবসায়ীই কর দিতে চায় না। আমরা চাই করহার কমিয়ে বেশি মানুষকে করের আওতায় নিয়ে আসা। এটা করতে পারলে কর আদায় কমবে না, বরং বাড়বে।

তবে এনবিআরের আয়কর নীতির সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে রাজস্ব আয়ের অনেক উৎস সংকুচিত হয়ে গেছে। বরং রাজস্ব আয়ের গতি বাড়াতে হবে। ফলে গণহারে ছাড়ের সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।

জ্বালানি ও অবকাঠামোর নিশ্চয়তা চায় ব্যবসায়ীরা

২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট তৈরির কাজ এখন পুরোদমে চলছে। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, অবকাঠামোসহ সব ধরনের সেবার নিশ্চয়তা চেয়েছেন। একই সঙ্গে শুল্ক-কর-ভ্যাট ইত্যাদি কমানোরও দাবি জানিয়েছেন। পৃথক পৃথক বৈঠকের ওই সব দাবিদাওয়া যখন এনবিআরের বাজেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পর্যালোচনা করে দেখছেন, তখনই ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ আরও ২৭টি দেশসেরা বাণিজ্য সংগঠনের নিজ নিজ খাতের শুল্ক-কর ও ভ্যাটছাড়ের অন্তত ১২৮টি প্রস্তাব দাখিল করেছে এনবিআরে।

এনবিআরের বেশ কয়েকজন কর্মকতা দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে জানায়, ব্যবসায়ীদের দেয়া প্রস্তাবের অর্ধেকও যদি মানতে হয় তাহলে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যতো দূরে থাক সন্তোষজনক রাজস্ব আয় করাও কঠিন হয়ে পড়বে।

প্রায় ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা প্রস্তাবিত বাজেটের আকার হতে যাচ্ছে আসন্ন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের। যা মোট জিডিপির প্রায় ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ। আর চলতি ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বাজেটের তুলনায় প্রায় ৮২ হাজার কোটি টাকা বেশি। এ প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা বেশি। যেখানে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে এনবিআর, এনবিআরবহির্ভূত এবং করবহির্ভূত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে আসন্ন বাজেটে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা হতে যাচ্ছে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে চলতি অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে আগামী বাজেটে। টাকার অঙ্কে বাড়তি ৬০ হাজার কোটি টাকা আদায় করতে হবে এনবিআরকে।

ব্যবসায়ীরা যে সব প্রস্তাব দিয়েছে

দেশের ২৮ টি ব্যবসায়ী সংগঠনের দেয়া ১২৮টি করছাড়ের প্রস্তাবের মধ্যে ফরেন চেম্বার মোট ৯টি প্রস্তাব দিয়েছে করছাড়ের। এর মধ্যে ব্যবসা শুরুর প্রথম তিন বছর নিট মুনাফার বিদ্যমান ১০ শতাংশ কর কমিয়ে ৮ শতাংশ আর অনাবাসী ব্যক্তির আয়ের উৎসে কর ২০-৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫-১০ শতাংশ করার প্রস্তাব অন্যতম।

মেট্রোপলিটান চেম্বার ৮টি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে আমদানি পর্যায়ে উৎসে আয়কর ৩-৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১-৫ শতাংশ করা, বিভিন্ন কৃষিজপণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে বিদ্যমান ২ শতাংশ উৎসে আয়কর প্রত্যাহার করা, পরিবহন সেবার বিদ্যমান ৫ শতাংশ কর কমিয়ে ২ শতাংশ করা ও সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকে জমা টাকার ওপর দেওয়া সুদের উৎসে আয়কর প্রত্যাহারের দাবি অন্যতম।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) করছাড়ের ১২টি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে করপোরেট কর, বস্ত্রশিল্পের আয়কর কমানো, দক্ষতা উন্নয়ন খাতের বিনিয়োগে কর অবকাশ অন্যতম। ঢাকা চেম্বার ৬টি করছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে কোম্পানির ব্যাংক থেকে অর্জিত সুদের আয়ের উৎসে কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে প্লাস্টিক বর্জ্যের বিদ্যমান ৪ শতাংশ উৎসে অগ্রিম কর প্রত্যাহার করা অন্যতম।

নিজেদের করছাড়ের বিষয়ে বিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, দেশের কর দেয়ার কথা সাড়ে ৩ কেটি লোকের। কিন্তু কর দিচ্ছে মাত্র ২৬ লাখ মানুষ। এনবিআর একটা মুখস্থ নীতির ওপর বিভিন্ন খাতের কোম্পানিগুলোর ওপর করহার নির্ধারণ করে। কোম্পানি যে ব্যবসায় লোকসান করতে পারে, সেটা এনবিআর মানতে চায় না।

চট্টগ্রাম চেম্বার ১৩টি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে বিদেশগামী দেশি জাহাজের মালামালের বিক্রেতাকে দেওয়া বিলের উৎসে কর বাতিল করা, স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানির উৎসে কর প্রতি টনে ৫০০ টাকার পরিবর্তে ২০০ টাকা করা, অন্যান্য কোম্পানির ক্ষেত্রে টার্নওভারের ন্যূনতম কর শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ২ শতাংশ করা অন্যতম।

সিলেট চেম্বার ১০টি প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ নিবন্ধিত কোম্পানির পরিশোধিত পুঁজির ওপর করপোরেট কর ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা অন্যতম। বিজিএমইএ ৮টি করছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ করা, করপোরেট কর ১২ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা, নগদ সহায়তার উৎসে কর প্রত্যাহার করা অন্যতম।

আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাব ৭টি করছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে আবাসন খাতে ৫ থেকে ১০ বছরের জন্য বিনা প্রশ্নে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ, আবাসন খাতের উদ্যোক্তাদের আয়কর কমানো, এলাকাভেদে জমি ও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের কর কমানো, নগর বিকেন্দ্রীকরণের স্বার্থে ৫ থেকে ১০ বছরের কর অবকাশ অন্যতম।

ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের করছাড় প্রস্তাবের মধ্যে রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তার উৎসে কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার প্রস্তাব অন্যতম। এর বাইরেও টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন ১টি, ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন ২টি, টায়ার টিউব উৎপাদক সমিতি ১টি, সিমেন্ট উৎপাদক সমিতি ২টি, মোবাইল অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন ৩টি, রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি ৫টি, প্লাস্টিক দ্রব্য রপ্তানিকারক সমিতি ১টি, বাংলাদেশ সুইটস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ৩টি, বিজিএপিএমইএ ১টি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি ১টি, অ্যাগ্রিকালচারার্স ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ১টি, বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ৭টি, বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন ৯টি, বিটিএমএ ১টি, টেরিটাওয়েল অ্যাসোসিয়েশন ১টি, বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন ১টি ও ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ৪টি করছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে।

Link copied!