ছবি: সংগৃহীত
‘রমজানে পণ্যের বাড়তি দাম: বাস্তবতা নাকি কারসাজি?’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য ডেইলি স্টার।
এতে বলা হয়, প্রতিবারের মত এ বছরেও রমজানের শুরুতেই ‘মোটা চাল থেকে সয়াবিন তেল, আলু থেকে ছোলা ও খেজুর থেকে ডিম—প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়েছে।’
রমজান শুরুর সপ্তাহখানেক আগে থেকেই ক্রেতারা প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে কাঁচাবাজার ও আশপাশের দোকানে যান। আর তখনই শুনতে হয় পণ্যের বাড়তি দামের কথা।
এবারের রোজা শুরুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকাবাসীকে মোটা চাল, ভোজ্যতেল, ছোলা, খেজুর ও ডিম গত বছরের তুলনায় বেশি দামে কিনতে হয়েছে।
আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে এসব পণ্যের বাড়তি দাম কম ও নির্দিষ্ট আয়ের পরিবারগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।
স্বস্তির বিষয় যে চিনি, আলু, পেঁয়াজ, মুরগির মাংস ও খোলা আটার জন্য বেশি দাম দিতে হয়নি।
২০২২ সালের কথাই ধরা যাক। রাষ্ট্রীয় সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে—রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগেই বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
আর ২০২৩ সালে পরিস্থিতি মিশ্র ছিল। কয়েকটি পণ্যের দাম আরও বেড়েছে, আবার কয়েকটি পণ্যের দাম কমেছে। ২০২৪ সালে অধিকাংশ পণ্যের দাম কিছুটা কম ছিল।
কিন্তু ২০২৫ সালে?
সয়াবিন তেল, ছোলা ও খেজুর আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়লেও রোজা শুরুর এক সপ্তাহ আগে পাঁচ পণ্যের দাম বেশি ছিল। রমজানে এসবের চাহিদা বেড়ে যায়।
কিন্তু প্রশ্ন: এটি কি কেবল বাড়তি চাহিদার কারণে হয়? নাকি কোনো কারসাজি?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুটোই। রোজার সময় বাড়তি চাহিদা স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। সরবরাহ ব্যবস্থায় কারসাজি হয়। কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর আধিপত্য ও দুর্বল সরকারি নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে।
এই বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে আসল কারণ কী? কারণগুলোর কিছু অনিবার্য, কিছু প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রথমত, দেশের অর্থনীতি উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে জর্জরিত। ২০২২ সাল থেকে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ৩০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। অর্থাৎ, ভোজ্যতেলের মতো আমদানি পণ্যের দাম বেশি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্দার আড়ালে অনেক কারসাজি আছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম পণ্যের বাড়তি দামের ঘটনাকে ব্যবসায়ীদের ‘খেলা’ বলে অভিহিত করেছেন।
চাহিদা বেড়ে গেলে সরবরাহ ব্যবস্থায় জড়িত অনেকে সর্বাধিক মুনাফার জন্য পরিস্থিতির সুযোগ নেন। সরকারের নজরদারি দুর্বল হওয়ায় তাদের ঠেকানো যায় না, বলেন তিনি।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও আছে বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম।
ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি বিক্রেতা আবুল হাশেমের মতে, মাত্র চার-পাঁচটি বড় প্রতিষ্ঠান চিনি ও ভোজ্যতেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
বিভিন্ন কারণে যখন তারা আমদানি কম করেন তখনেই সরবরাহে ঘাটতি হয়। দাম আপনা-আপনিই বেড়ে যায়, বলেন তিনি।
আবুল হাশেম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘আমরা চাহিদার পরিমাণের যে তথ্য জানি তা পুরনো। এখনো অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে এক দশক আগের তথ্যের ওপর নির্ভর করছি। যদিও জনসংখ্যা বেড়েছে। যদি প্রকৃত চাহিদা কত তা না জানি, তাহলে কীভাবে আমরা সঠিকভাবে পণ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করব?’
খুচরা বিক্রেতারাও সুযোগ বুঝে অনেক সময় পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। যখন চাহিদা বেশি থাকে, তখন অনেক ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। কখনো কখনো সীমা ছাড়িয়ে যায়।
ছোট পোল্ট্রি খামারি ও সরবরাহকারীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদারের অভিযোগ ‘বড়’ প্রতিষ্ঠানগুলো সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। ‘কৃত্রিমভাবে’ দাম বাড়িয়ে দেয়।
তিনি ২০২৩ সালের রোজার একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেন।
ব্যবসায়ীদের ওপর সরকার অভিযান চালানোর পর রাতারাতি ব্রয়লার মুরগির দাম অনেক কমে যায়। তার কথায়, ‘এতেই প্রমাণিত হয় দাম বাড়ানো হচ্ছে।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি এস এম নাসের হোসাইন ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বারবার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। তবে বর্তমানে পর্যবেক্ষণের নামে যা হচ্ছে তা মিডিয়া ট্রায়াল ছাড়া আর কিছুই না।’
‘শুধু কয়েকটি পাইকারি ও খুচরা বাজারে অভিযান চালানো হচ্ছে। এটি বাজার নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদ্ধতি নয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এসব অভিযানের পর ফলোআপের অভাব। দেশে ফলোআপ প্রায় নেই বললেই চলে।’
দেশের শীর্ষ পণ্য আমদানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারী মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার মনে করেন পণ্যের বাড়তি দামের একটি কারণ হচ্ছে বিনিময় হার।
ডলারের দাম ক্রমাগত বাড়তে থাকায় আমদানি খরচ বেড়েছে। আবার যখন লাখ লাখ মানুষ একই সময়ে একই আমদানি পণ্য কিনতে যান তখন সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হিমশিম খেতে হয়, বলেন তিনি।
খুচরা বিক্রেতারা এই ব্যবধানের সুযোগ নিয়ে দাম আরও বাড়িয়ে দেন বলে মনে করেন তিনি।
সরকার কি পারবে?
সরকার অতীতে অনেকবার উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। অভিযান, অস্থায়ী মূল্যসীমা, এমনকি সরাসরি প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করলেও স্থায়ী সমাধান দিতে পারেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে যা করা হচ্ছে এগুলো সবই স্বল্পমেয়াদি সমাধান।
তাদের মতে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য ও সঠিক চাহিদা নির্ণয়ের অভাব সমাধান না করে সরকার প্রায়ই দ্রুত হস্তক্ষেপের আশ্রয় নেয়। ফলে সামগ্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন হয় না।
মোয়াজ্জেম সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি ডিজিটাল বাজার ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে সরবরাহ-চাহিদার প্রকৃত পরিস্থিতি জানার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এটা মানা হলে দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগে সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারবে।
কিন্তু তা শিগগিরই ঘটবে কিনা এ নিয়ে অনেকে সন্দিহান।
কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও সরকারের মধ্যে `গভীর` যোগাযোগ আছে। ফলে যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয় না।
মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানগুলো এতটাই শক্তিশালী যে সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দ্বিধা করে।’
প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে রোজায় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া কি অনিবার্য বাস্তবতা? বেশির ভাগ মানুষই তাই মনে করেন।
কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতি চলমান থাকায় রোজায় পণ্যের বাড়তি দাম কম আয়ের পরিবারগুলোর ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে।
রোজা শুরুর পর যা ঘটে তা আরও কৌতূহলোদ্দীপক।
গত চার বছরে টিসিবির তথ্যে দেখা গেছে—রোজার মাসে এক সপ্তাহের মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল বা এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কমেও যায়।
সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চললে রোজার প্রথম সপ্তাহের পর দাম কমতে পারে। যদি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ ও দুর্বল তদারকির সুরাহা না হয়, তবে বছরের পর বছর তা চলতেই থাকবে।
আপাতত ক্রেতাদের খরচে কাটছাঁট ছাড়া আর কোন গতি নেই।