কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মতে, ‘ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম- এই ত্রিবর্গের মধ্যে অর্থই প্রধান, যেহেতু ধর্ম্ম ও কাম অর্থ দ্বারাই সাধ্য হয়’ (অর্থ এব। প্রধান ইতি কৌটিল্য, অর্থমূলৌহি ধর্ম্মকামাবিতি।) সম্ভবত এইকারণে মানুষ অর্থ উপার্জনে দিগ্বিদিক ছুটে চলেছে। কিছুদিন আগেই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালের গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, দ্রুত ধনী হওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে! অর্থাৎ বিশ্বে সব থেকে তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া যায় বাংলাদেশে। আর এই ধনী কীভাবে হওয়া যায়?
কমবেশি সবাই নিশ্চয়ই একমত হবেন, ব্যবসায় অতিমুনাফা করা ছাড়া এটা অনেকটা অসম্ভব। কেননা আমাদের দেশে কতটুকু লাভ করলে সেটা যথাযথ হবে বা ন্যায়সঙ্গত হবে এর কোন মাপকাঠি নেই। উল্লেখযোগ্য আইনি হাতিয়ার নেই যার মাধ্যমে অতি মুনাফাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আবার অনেক ক্ষেত্রে যেটুকু আইনপ্রয়োগের সুযোগ আছে সেটাও করা হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সেইসব ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যাঁদের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা তারাই সরাসরি এইসব ব্যবসার সাথে যুক্ত।
যাই হোক, এই দ্রুত ধনী হওয়া অতিমুনাফাকারীদের মুনাফার বলি হচ্ছে দেশের আপামর সাধারণ জনতা। কোনো পণ্য যে দামে পাওয়ার কথা তা কিনতে হচ্ছে কয়েকগুণ দামে। এইরকম একটি সময়ে একজন আরিফুজ্জামান তুহিন দেখাচ্ছেন ন্যায্যদামে পণ্য বিক্রির তেলেসমাতি!
যখন ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য হয়েছে মুনাফা, তখন তিনি ন্যায্য মুনাফা করার চিন্তার সাথে ভাবছেন সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নিয়ে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে ফল, সবজি, চাল, তেলসহ নিত্যপণ্য রাজধানী ঢাকায় এনে স্বল্পমূল্যে বিক্রি করছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর এই উদ্যোগ ইতোমধ্যে বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
আরিফুজ্জামান তুহিন পেশায় একজন সাংবাদিক। কয়েকজন বন্ধু মিলে মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে ‘আড়ৎ লিমিটেড’ নামে শো-রুম গড়ে তুলেছেন। তিনি জানান, সুপারশপে যেসব পণ্য পাওয়া যায় তাঁর আড়তেও সেসব পণ্যই পাওয়া যায়। তবে পার্থক্য হলো দামের। সুপারশপ থেকে কিছু কিনলে সেই পণ্যের নির্ধারিত ভ্যাটের চেয়েও বাড়তি ভ্যাট (পচনশীল জিনিস বাদে) হিসেবে সাড়ে ৭% টাকা দিতে হয় ক্রেতাকে। কিন্তু এই অতিরিক্ত ভ্যাট আরিফুজ্জামানের আড়তে দিতে হয় না।
চলছে রোজার মাস। ইফতারি পণ্য হিসাবে তরমুজের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগেও বাজারে ৮০ টাকা কেজিদরে বিক্রি হয়েছে তরমুজ। ঠিক তখনও তুহিনের আড়তে ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে তরমুজ। এখন ৫ থেকে ৭ কেজি আকারের তরমুজ ২০০ টাকায় এবং ৮ থেকে ১২ কেজি আকারের তরমুজ ২৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।
তিনি বলেন, ‘এই দরে তরমুজ বিক্রি করেও লাভ করা সম্ভব। অথচ ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় প্রচুর দামে তরমুজ বিক্রি করছে। এই টাকা কৃষক পাচ্ছে না। টাকা চলে যাচ্ছে নেতা বা চাঁদাবাজদের পকেটে।’
এবার রোজার মাসে তরমুজ বিক্রির অভিজ্ঞতা জানিয়ে উদ্যোক্তা তুহিন বলেন, ‘ভোলার চরফ্যাশন থেকে আমরা একটি তরমুজ ক্ষেত কিনেছিলাম ২ লাখ টাকায়। এরপর তরমুজ ঢাকায় আনা বাবাদ পরিবহন খরচ ৫৫ হাজার টাকা। পরিবহন খরচ যদি কম হতো তাহলে মানুষের কাছে আরও কম দামে তরমুজ বিক্রি করা যেত।’
‘৪ কেজির বেশি ওজনের তরমুজ ১৫০ টাকায় এবং ৪ কেজির কম হলে ১০০ টাকায় বিক্রি করেছি। তারপরও হিসাব করে দেখেছি, আমরা যে দরে তরমুজ বিক্রি করেছি তাতেও ১০% মুনাফা থাকে। তাহলে বাজারে যাঁরা তরমুজ বিক্রি করছেন তাঁরা পারছেন না কেন? এতেই বোঝা যায় সাধারণ মানুষ কার কাছে জিম্মি!’ যোগ করেন তুহিন।
তিনি বলেন, ‘আমরা স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে দেখেছি তাতে অনেক বেশি লাভ না হলেও লোকসান হয় না। উৎপাদন খরচ ও পরিবহন খরচ হিসাব করে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করলে মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায় অন্য জায়গায়। পাইকারী বিক্রেতাকে নিয়মিত চাঁদা দিতে হয় নেতাদের। ফলে দিনশেষে বিক্রেতার নিজের লাভ বলতে কিছুই থাকে না। সেকারণে পণ্যের দাম বাড়িয়ে এই চাঁদাও সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই আদায় করা হয়।’
আড়তে সব ধরনের পণ্য বাজারমূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি হয় বলে জানান এই উদ্যোক্তা। সরিষার তেলের বাজারদর প্রতি লিটার ২৫০ টাকা। কিন্তু আড়তে সরিষার তেল বিক্রি হচ্ছে ১৯০ টাকা লিটারে। লাউ ২০ টাকা পিস, আর ফুলকপি প্রতি পিস ২৫ টাকা। চালের দামও বাজারের চেয়ে ৪ থেকে ৮ টাকা কম এখানে।
গত বছর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে দেশে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যায়। কিন্তু তখন আগের দামেই পেঁয়াজ বিক্রি করে আড়ত। এই প্রসঙ্গে আরিফুজ্জামান তুহিন বলেন, ‘তখন আমাদের মজুতে যত পেঁয়াজ ছিল তা আগের দামে বিক্রি করেছি। মানুষের উপকার করতে গিয়ে আমরা লক্ষ্য করেছি, অনেকে হুমড়ি খেয়ে পেঁয়াজ কিনেছে। যাঁর ২ কেজি দরকার, তিনি নিয়েছেন ১০ কেজি। আমরা কথা দিয়েছিলাম আগের দামেই পেঁয়াজ বিক্রি করবো। কিন্তু বাজারদর নিয়ে মানুষ এতটাই অনিশ্চয়তায় ভোগে যে কম দাম পেলেই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিনে ফেলে।’
শুধু তরমুজ নয়, সব ধরনের মৌসুমী ফল বিক্রি হয় আড়তে। প্রতিবছর স্বল্পমূল্যে আম, লিচু বিক্রি করেন তাঁরা।
আরিফুজ্জামান তুহিনের ‘আড়ৎ’ বেশ সাড়া ফেলেছে। ন্যায্য দামে পণ্য কিনতে পেরে এ ধরনের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন অনেকেই।