ভীড় এড়াতে এখনই জমা দিন আয়কর রিটার্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক

অক্টোবর ১০, ২০২২, ১১:৩৪ পিএম

ভীড় এড়াতে এখনই জমা দিন আয়কর রিটার্ন

আপনার বার্ষিক আয় যদি তিন লাখ টাকার বেশি হয়, তাহলে আপনাকে আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে। এরমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া। ভীড় এড়াতে এখনই কর অফিসে গিয়ে আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছেন অনেকে। আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২১ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের হিসাব করে বার্ষিক রিটার্ন জমা দিচ্ছেন তাঁরা। 

জমি রেজিস্ট্রি, ইউটিলিটি সংযোগ বা ক্রেডিট কার্ড পাওয়ার মতো ন্যূনতম ৩৮টি পরিষেবা পেতে হলে আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে রেকর্ড পরিমাণ ৩ লাখ ৩৩ হাজার রিটার্ন দাখিল করেছেন করদাতারা। গত বছরের একই সময়ে রিটার্ন জমা হয়েছিল এক লাখ করদাতার। 

এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সেবা পেতে আয়কর বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক করার ঘোষণায় আশাতীত সাড়া মিলেছে। এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, এবারের বাজেটে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করায় রিটার্ন জমা গত বছরের তুলনায় ৩০ শতাংশের মতো বাড়তে পারে।

এ প্রসঙ্গে এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ৪০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। যদিও গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে মাত্র ২৪ লাখ করদাতা আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন।

সাধারণত প্রতি অর্থবছরের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাস জরিমানা ছাড়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়া যায়। ফলে আর মাত্র ২০ দিন পর শুরু হবে আয়কর মেলা। জরিমানা ছাড়া রিটার্ন জমা দেওয়া যাবে নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত।

এ মাসে কর মেলার আয়োজন করবে এনবিআর। তবে প্রথমবার রিটার্ন জমাদানকারীরা আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বিনা জরিমানায় আয়কর রিটার্ন দিতে পারবেন। অর্থাৎ কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকলেও যারা এত দিন বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমা দেননি, তাদের জন্য এবার রয়েছে বড় সুযোগ। তাঁরা জরিমানা ছাড়াই রিটার্ন জমা দিতে পারবেন।

বর্তমানে প্রায় ৭৯ লাখ টিআইএন-ধারী রয়েছেন। এর মধ্যে চার লাখের মতো চলতি অর্থবছরে টিআইএন নিয়েছেন। বাকি ৭৫ লাখ টিআইএন-ধারী পুরনো। এদের মধ্যে প্রতি বছর ২৫ লাখের মতো রিটার্ন জমা দিলেও বাকি ৫০ লাখ রিটার্ন জমা দেন না।  যদিও রিটার্ন জমা না দিলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাসহ বিলম্ব মাশুল এবং নির্ধারিত আয়ের বিপরীতে সুদ আরোপ করার বিধান আছে। বিশেষ করে দেশের সব টিআইএন-ধারীকে করের আওতায় আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড চলতি অর্থবছর থেকে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছে।

এত দিন বলা হচ্ছিল, টিআইএন থাকলেই রিটার্ন দিতে হবে। তবে রিটার্ন জমা না দিয়েও পার পাওয়া যেত,  কিন্তু এবার ৩৮ ধরনের সেবা পেতে হলে রিটার্ন জমার রসিদ দেখাতে হবে। এসব সেবা পেতে রিটার্ন জমা দিয়ে রসিদ সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। রসিদ যাচাই না করলে যেসব প্রতিষ্ঠান এই সেবা দেবে, তাদের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। ২০ লাখ টাকার বেশি ব্যাংকঋণ পাওয়া, পাঁচ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার, অনলাইনে বেচাকেনার ব্যবসা, রাইড শেয়ারিং বা শরিকি যাত্রায় মোটরগাড়ি দেওয়া ইত্যাদি। এমনকি সন্তানকে ইংরেজি মিডিয়ামে (ইংলিশ ভার্সন) পড়াশোনা করালেও রিটার্ন জমা দিতে হবে। তাই ভবিষ্যতে এসব সেবা পেতে এবার রিটার্ন দিতেই হবে। এ ছাড়া গাড়ির মালিক, অভিজাত ক্লাবের সদস্য, কোম্পানি পরিচালক, বণিক সংগঠনের সদস্য, পৌর থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থী হলেও রিটার্ন দিতে হবে।

ন্যূনতম কর

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা। অন্যান্য সিটি করপোরেশনে অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম কর চার হাজার টাকা। সিটি করপোরেশন ছাড়া অন্য যেকোনও এলাকায় অবস্থিত করদাতার ন্যূনতম কর তিন হাজার টাকা। এছাড়া করমুক্ত সীমার চেয়ে বেশি আয় আছে, এমন করদাতার আয়করের পরিমাণ বা বিনিয়োগজনিত কর রেয়াত বিবেচনার পর প্রদেয় আয়করের পরিমাণ ন্যূনতম আয়করের চেয়ে কম বা শূন্য বা ঋণাত্মক হলেও তাকেও ন্যূনতম আয়কর দিতে হবে।

কাদের জন্য রিটার্ন জমা

দুই শ্রেণির মানুষ আয়কর দেন। প্রথমত, যাদের করযোগ্য আয় আছে। আর যাদের ব্যবসা বা ব্যক্তিগত কাজে টিআইএন প্রয়োজন হয়, তাদের অবশ্যই রিটার্ন জমা করতে হবে। ন্যূনতম করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকা। এর বেশি করযোগ্য আয় থাকলে অবশ্যই কর দিতে হবে। এ ছাড়া সর্বনিম্ন কর এলাকাভেদে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ব্যক্তি-করদাতার আয় যদি বছরে ৩ লাখ টাকার বেশি হয়, তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি, নারী ও ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের করদাতার আয় যদি বছরে সাড়ে তিন লাখ টাকার বেশি হয়, গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা করদাতার আয় যদি বছরে ৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকার বেশি হয় এবং প্রতিবন্ধী করদাতার আয় ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে তার রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক।

এ ছাড়া কারও ১২ ডিজিটের টিআইএন থাকলে, গত তিন আয় বছরে কর নির্ধারণ হয়ে থাকলে, কেউ কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার পরিচালক বা কর্মী হলে, ফার্মের অংশীদার হলে, সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান থেকে বছরের যেকোনও সময় ১৬ হাজার টাকার বেশি মূল বেতন নিলে তাকে রিটার্ন দাখিল করতে হবে। 

রিটার্ন ফরম মিলবে কোথায়

করদাতারা তাঁদের নিজস্ব আয়কর সার্কেল অফিস থেকে অথবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকেও রিটার্ন ফরম সংগ্রহ করতে পারবেন। রিটার্ন জমা দিতে হবে যার যার সার্কেল অফিসে। অনলাইনেও রিটার্ন জমা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, তবে তা সব সার্কেলে এখনও কার্যকর নয়।

স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা

সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে করদাতা নিজের আয় নিজে হিসাব করে আয়কর নিরূপণ করেন। এক পৃষ্ঠার ফরমে অল্প কিছু তথ্য দিয়ে এই রিটার্ন দাখিল করা যায়।

সাধারণ পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা

করদাতার ১২ ডিজিটের টিআইএন না থাকলে সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিল করা যাবে না। তাকে সাধারণ পদ্ধতিতে রিটার্ন জমা দিতে হবে। এছাড়া মোট আয়কর ও সারচার্জ ৩০ নভেম্বর বা উপ-কর কমিশনারের দেওয়া বাড়তি সময়ের মধ্যে পরিশোধ করা না হলে সেক্ষেত্রেও রিটার্ন সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে পড়বে না।

৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন জমা না দিলে

নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন জমা না দিলে জরিমানা ও করের ওপর বিলম্ব সুদ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে নিজের সার্কেলের উপ-কর কমিশনারের কাছে আবেদন করে সময় নিতে হবে।  কিন্তু আবেদন না করলে তাকে প্রদেয় করের ১০ শতাংশ বা ১ হাজার টাকার মধ্যে যা বেশি, ওই পরিমাণ অর্থ এবং প্রতিদিনের জন্য ৫০ টাকা করে জরিমানা দিতে হয়।

রিটার্নে ভুল তথ্য

সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে রিটার্ন দাখিলের পর যদি কোনও করদাতা দেখেন যে, অনিচ্ছাকৃত ভুলে কম আয় দেখানো হয়েছে, অথবা বেশি রেয়াত বা কর অব্যাহতি বা ক্রেডিট নেওয়া হয়েছে, তাহলে তিনি ভুল সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। এমনকি অন্য যেকোনও হিসাব বা কর পরিগণনা কম বা বেশি হলেও সংশোধনী রিটার্ন দাখিল করা যায়। উপ-কর কমিশনারের কাছে ভুল সংশোধনীতে ভুলের ধরন ও কারণ উল্লেখ করে লিখিত বিবরণী জমা দিতে হবে।

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন যাচাই

সম্প্রতি কর বিভাগ এমন একটি অনলাইন পরিষেবা চালু করেছে, যার মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে লগইন করে যাচাই করতে পারবেন করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরের (ট্যাক্সপেয়ার আইডেন্টিফিকেশন নম্বর-টিআইএন) বিপরীতে রিটার্ন দাখিল হয়েছে কিনা।  গত ২১ আগস্ট চালু হয় এই অনলাইন পরিষেবা। রাজস্ব বিভাগ বলছে, চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত এই ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো থেকে ব্যাপক সাড়া পেয়েছে।

এখন প্রতিদিন ৩ হাজারের বেশি রিটার্ন যাচাই করা হচ্ছে। এটি ধীরে ধীরে আরও বাড়বে। রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তাদের মতে, প্রায় ৩ লাখ সরকারি ও বেসরকারি অফিস রয়েছে, যাদের রিটার্ন দাখিল যাচাইয়ের প্রয়োজন হয়।

রিটার্ন জমায় রেয়াত

রিটার্ন দেওয়ার সময় করদাতাদের গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত আয়ের আয়ের ২০ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পারবেন। ১৫ শতাংশ কর রেয়াত পাবেন। কর রেয়াত নিতে হলে জীবনবিমার কিস্তির প্রিমিয়াম রসিদ, ভবিষ্যৎ তহবিলে চাঁদার সনদ, ঋণ বা ডিবেঞ্চার, সঞ্চয়পত্র, স্টক বা শেয়ারে বিনিয়োগের প্রমাণপত্র, ডিপোজিট পেনশন স্কিমে চাঁদার সনদ, কল্যাণ তহবিলে চাঁদা ও গোষ্ঠী বিমার কিস্তির সনদ, যাকাত তহবিলে চাঁদার সনদ জমা হবে। এছাড়া বেতন খাতের আয়ের দলিল, সিকিউরিটিজের ওপর সুদ আয়ের সনদ, ভাড়ার চুক্তিপত্র, পৌরকরের রসিদ, বন্ধকি ঋণের সুদের সনদ, মূলধনী সম্পদের বিক্রয় কিংবা ক্রয়মূল্যের চুক্তিপত্র ও রসিদ, মূলধনী ব্যয়ের আনুষঙ্গিক প্রমাণপত্র, শেয়ারের লভ্যাংশ পাওয়ার প্রমাণপত্র (ডিভিডেন্ড ওয়ারেন্ট) এবং সুদের ওপর উৎসে কর কাটার সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে।

কাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা

যিনি চলতি ২০২২-২৩ করবর্ষে প্রথমবার রিটার্ন দাখিল করবেন, তিনি আগামী বছরের ৩০ জুন তারিখের মধ্যে যেকোনও দিন সর্বজনীন স্বনির্ধারণী পদ্ধতিতে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন।

এ ছাড়া যারা কয়েক বছর আগে রিটার্ন জমার উপযুক্ত হয়েছেন, কিন্তু তা করেননি, তারা এ বছর সব রিটার্ন একসঙ্গে দাখিল করতে পারবেন। এ বছর করদাতাদের জন্য জরিমানা ছাড়া আগের আয় বছরের রিটার্ন দাখিলেরও সুযোগ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

আয়কর রিটার্ন জমা বাড়াতে চলতি অর্থবছরে বিশেষ একটি উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। যেসব করদাতার শনাক্তকরণ নম্বরের (টিআইএন) বিপরীতে আয়কর রিটার্ন জমা হয়নি, তাদের ২০২২-২৩ অর্থবছরে জরিমানা ছাড়াই রিটার্ন দাখিলের সুযোগ দিয়েছে এনবিআর।

জিডিপিতে করের অবদান বিবেচনায় বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম পিছিয়ে থাকা একটি দেশ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিওতে বাংলাদেশের ওপরে অবস্থান করছে। ধীরে ধীরে এতে বাংলাদেশের অবনমন হচ্ছে। একসময় ট্যাক্স টু জিডিপি রেশিও ১০ শতাংশ থাকলেও ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী, তা ৮ শতাংশের নিচে নেমে গেছে।

 

Link copied!