আম দিবস

আমজনতার আমের গল্প

ফারহানা জিয়াসমিন

জুলাই ২৩, ২০২৩, ১২:০২ এএম

আমজনতার আমের গল্প

সংগৃহীত ছবি

আমজনতা থেকে এলিট শ্রেণি- আম কার না প্রিয়! এক বসায় অনেকেই কেজির পর কেজি আম খেয়ে ফেলেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক নাকি একবার একসাথে ৪৮টি আম খেয়েছিলেন। মাওলানা ভাসানী একবারে মোটামুটি ১৪-১৫টি আম খেতে পারতেন। বিখ্যাত মানুষদের আম খাওয়ার গল্প অনেকেরই জানা তবে আমজনতাও আম খেতে পারেন হিসাব ছাড়াই।

বাংলার ইতিহাসের সাথে আমের সম্পর্কও বহুকালের। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে অস্ত গিয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। আবার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে শপথ নিয়েছিল যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার।

তাই বলা যায় বাংলার আমজনতার জীবনে আম জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে।

বাঙালি শিশু কথা বলতে শেখার আগেই ছড়া শোনে, আম পাতা জোড়া জোড়া কিংবা ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ। তারপর তাকে ‘আমার প্রথম শিক্ষা’তেও পড়ানো হয় ‘অ’-তে অজগরটি আসছে তেড়ে, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে। বিদ্যালয়ে প্রতিদিন শিশুরা জাতীয় সঙ্গীতে সমস্বরে গেয়ে ওঠে, ‘ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে!’

বাংলা উপন্যাসের পাতায়ও ঝড় এলেই আম কুড়াতে আমের বনে ছুটে যাওয়ার গল্প কম নয়। বিভূতিভূষণের অপু-দূর্গার আম আঁটির ভেপুর গল্প পড়েছেন তো সবাই ই।

আমের মধ্যে হরেক রকমের প্রজাতি আছে। জনশ্রুতিতে আমের নামকরণের দারুণ ইতিহাস শোনা যায়।

ফজলি আম: ১৮০০ সালে ফজলি বিবি নামে এক বৃদ্ধা বাস করতেন গৌড়ের এক প্রাচীন কুঠিতে। তার বাড়ির উঠনেই ছিলো একটি আমগাছ। তিনি গাছটির খুব যত্ন নিতেন। ওই এলাকার কালেক্টর রাজভেনশ একবার বৃদ্ধার ঘরের কাছে শিবির স্থাপন করেন। তার আগমনের খবর পেয়ে বৃদ্ধা তার গাছের আম খাওয়াতে তার সাথে দেখা করতে যান। সেই আম খেয়ে কালেক্টর সাহেব খুব মজা পেয়ে আমের নাম জানতে চান। আমের নাম ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করেন। বৃদ্ধা তেমন ইংরেজি বুঝেন না। ‘নেম’ শুনে ভেবেছেন তার নাম জানতে চেয়েছেন কালেক্টর। তখন নিজের নাম বলেন ফজলি বিবি। সেই থেকে এই আমের নাম হয়ে যায় ফজলি আম।

আম্রপালি আম: প্রায় ২৫০০ বছর আগে ভারতের বৈশালী রাজ্যে এক ব্যক্তি আম গাছের নিচে একটি মেয়ে শিশুকে খুঁজে পান। আম গাছের নিচে পাওয়ায় তার নাম রাখা হয় আম্রপালি। শৈশব পেরিয়ে কিশোরে পা দিতেই আম্রপালির সৌন্দর্যে দেশ- বিদেশের রাজা- রাজপুত্রসহ সাধারণ মানুষ পাগল হয়ে যায়। তখন বৈশালীর ক্ষমতাবান ও ধনবান ব্যক্তিরা সিদ্ধান্ত নেন আম্রপালিকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। সে হবে একজন নগরবধূ অর্থাৎ পতিতা। 

একবার গৌতম বুদ্ধ কয়েকশ সঙ্গী নিয়ে বৈশালী রাজ্যে গেলে এক বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে দেখে ভালো লাগে আম্রপালির। চার মাস তার কাছে সেই সন্ন্যাসীকে রাখার জন্য গৌতম বুদ্ধকে অনুরোধ করেন তিনি। গৌতম বুদ্ধ রাজি হন এবং বলেন, সে চার মাস থাকলেও নিষ্পাপ হয়েই ফিরে আসবে এটা আমি নিশ্চিত। চার মাস শেষে সবাইকে অবাক করে দিয়ে তরুণ শ্রমণ ফিরে আসেন। আম্রপালি তখন বুদ্ধকে বলেন, এই প্রথম কোনো পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালী নগরবধূ আম্রপালি। তারপর আম্রপালি সবকিছু দান করে বাকী জীবন গৌতম বুদ্ধের চরণেই কাটিয়ে দেন। 

১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা নীলম ও দশহরি জাতের আমের মধ্যে সংকরায়নের মাধ্যমে এক নতুন জাতের আম উদ্ভাবন করেন এবং নাম রাখেন আম্রপালি।

ল্যাংড়া আম: মুঘল আমলে ল্যাংড়া আমের চাষ শুরু হয় তবে তবে আমের নামকরণ হয় আঠারো শতকে। সে সময় এক ফকির এই আমের চাষ করেন। সেই ফকিরের পায়ে একটু সমস্যা ছিলো বলে খুঁড়িয়ে হাটতেন তিনি। তার বাগানে অনেক আমের ফলন হয়। তখন লোকজন মজা করে সেই আমের নামকরণ করে ‘ল্যাংড়া আম’।

আশ্বিনা আম: আশ্বিন মাসে এই আম পাকে বলে আশ্বিনা আম নামকরণ করা হয়। আগস্ট মাস পর্যন্ত এই আম পাওয়া যায়। কিছু কিছু এলাকায় সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকেও পাওয়া যায়।

গুটি আম: দেখতে ছোট এক প্রকারের আম খেয়ে সেই আম নিজের বাগানে পুঁতেছিলেন মালদহের এক দরিদ্র কৃষক। সেই আঁটি থেকেই জন্ম হয়েছিল আরেক আম গাছ। কাঁচা অবস্থায় এই আম খুব টক হয় কিন্তু পাকলে অনেক মিষ্টি হয়। এই আঁটি বা গুটি থেকে এই গাছ জন্মায় বলে এই আমের নাম হয় গুঁটি আম।

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতে আমের চাষ শুরু হয়। ২২ জুলাই দেশটিতে জাতীয়ভাবে আম দিবস পালিত হয়। আর বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল হলেও ফলের রাজা আম। আর বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ। ভারত, পাকিস্তান, হাইতি ও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম।

বসন্ত পেরোনোর আগেই আমের অপেক্ষায় যেন আর তর সয় না। কাঁচা আম পেরে লবণ-মরিচ মাখিয়ে বা কাসুন্দি দিয়ে প্রতিদিন দুপুর শুরু হওয়ার সময়টায় না খেলে অনেকেরই সয় না। আমের আচার, আমসত্ত্ব,মোরব্বা,তরকারি কতভাবে যে কাঁচা আম খাওয়া যায় তা বাঙালির চেয়ে কে ভালো জানে! আর পাকা আম তো জুস, আম-দুধ, আম-মুড়ি, মুজি ম্যাঙ্গো, জেলি, কেক, আইসক্রিম, মিষ্টির মতো নানা রকমের খাবার বানিয়ে খাওয়া যায়।

মধুমাস মানেই আমের গন্ধে ম-ম চারপাশ। আম দিবসে আমের গল্প পড়তে পড়তে আম খেয়ে নিন মনভরে।

Link copied!