পুলিশের গুলিতে এক কিশোর নিহতের ঘটনায় ব্যাপক বিক্ষোভে উত্তাল ফ্রান্স। দাঙ্গা দমনে ‘সব বিকল্প’ বিবেচনায় আছে বলে ঘোষণা দিয়েছে দেশটির সরকার। যাকে ঘিরে চার দিন ধরে জ্বলছে ফ্রান্সের বিভিন্ন শহর, কে এই নাহেল এম?
১৭ বছরের নাহেলের বেড়ে ওঠা প্যারিসের পশ্চিমে নতেঁ শহরে। সেখানে গত মঙ্গলবার গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় এক তল্লাশিচৌকিতে পুলিশের গুলিতে নিহত হয় সে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেশজুড়ে টানা বিক্ষোভ চলছে।
একমাত্র সন্তান নাহেলকে বড় করেছেন মা। সে পণ্য ডেলিভারির কাজ করত। খেলত রাগবি লিগে।
অবশ্য নাহেলের পড়াশোনায় ছেদ আছে। বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি হতে চেয়েছিল সে। বাসার অদূরে সুরেসনেসের একটি কলেজে ভর্তি হয়েছিল।
নাহেল ও তার মা মোনিয়া আলজেরিয়ার বংশোদ্ভূত। তবে তার বাবার পরিচয় জানা যায়নি। যারা নাহেলকে চেনে, তাদের সবার একই কথা—নাহেল খুব লক্ষ্মী ছেলে।
কলেজে নাহেলের ক্লাসে ছিল উপস্থিতি কম। তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই। তবে পুলিশ তাকে চিনত।
ঘটনার দিন মা কাজে যাওয়ার আগে চুমু দিয়ে নাহেল বলেছিল, ‘মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ মঙ্গলবার সকাল নয়টার কিছুক্ষণ পর খবর আসে, প্রাইভেট কার চালিয়ে পুলিশের তল্লাশিচৌকি পার হওয়ার সময় নাহেলকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
ছেলে হারানো মা মোনিয়ার আর্তনাদ, ‘আমি এখন কী করব? আমি আমার সবকিছু তার জন্য উৎসর্গ করেছি। আমার দশটি নয়, একটি সন্তান। সে আমার জীবন, আমার সেরা বন্ধু ছিল।’ দাদি নাহেলকে ‘নরম মনের লক্ষ্মী ছেলে’ বলতেন।
সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা অলিভিয়ের ফাউর বলেন, ‘নির্দেশমতো গাড়ি না থামানো মানে এই নয় যে কাউকে হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি শিশুর ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার আছে।’
গত তিন বছর নাহেল পাইরেটস অব নতেঁ রাগবি ক্লাবে খেলেছে। ওভালে সিটিয়েন নামের একটি সমিতি স্কুলে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে এমন কিশোর-কিশোরীদের জন্য একটি কর্মসূচি পরিচালনা করে থাকে। নাহেলও ওই কর্মসূচিতে অংশ নিত।
ওভালে সিটিয়েনের এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো, সুবিধাবঞ্চিত এলাকার লোকজনকে শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়ানো। নাহেল বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির কাজ শিখছিল।
নাহেলকে খুব ভালো করে চিনতেন ওভালে সিটিয়েনের প্রেসিডেন্ট জেফ পুচ। কেবলই কয়েক দিন আগে তার সঙ্গে জেফের দেখা হয়েছিল। সব বাধা কাটিয়ে রাগবি নিয়ে এগিয়ে যেতে যাওয়া শিশুটির সঙ্গে কথা হয়েছিল তাঁর।
জেফ বলেন, নাহেল এমন এটি ছেলে ছিল, যার মধ্যে সামাজিক ও পেশাগতভাবে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে ওঠার আগ্রহ ছিল। অন্য শিশুদের মতো নয়, যারা মাদক বা কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তিনি কিশোর নাহেলের ‘আচরণ উদাহরণ দেওয়ার মতো’ বলেও প্রশংসা করেন।
নাহেলের মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরই অ্যাম্বুলেন্সের চালক মারোয়ান এক পুলিশ কর্মকর্তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নাহেল ছিল তাঁর ছোট ভাইয়ের মতো। তিনি তাকে বেড়ে উঠতে দেখেছেন। তার মনটা ছিল নরম। সে সবাইকে সাহায্য করত। সে কখনো কারও ওপর হাত তোলেনি এবং আক্রমণাত্মক মনোভাবের ছিল না।
নাহেলের মা মোনিয়া ফ্রান্স ৫ টিভিকে বলেন, তাঁর বিশ্বাস, ওই পুলিশ কর্মকর্তা নাহেলের চেহারা আরব দেশের নাগরিকের মতো দেখতে পেয়ে তার জীবন নিতে চেয়েছিল। তিনি শুধু এই ব্যক্তিকে দোষারোপ করেছেন, গোটা পুলিশ বাহিনীকে নয়। তিনি বলেন, ‘আমার অনেক বন্ধু পুলিশে আছে, তারা আন্তরিকভাবে আমার পাশে আছে।’
নাহেল নিহত হওয়ার জেরে চলমান সহিংস বিক্ষোভ চতুর্থ দিনে গড়িয়েছে। একদিকে চলছে বিক্ষোভকারীদের জ্বালাও-পোড়াও, অন্যদিকে চলছে পুলিশের ব্যাপক ধরপাকড়। বিক্ষোভের তৃতীয় রাতে ফ্রান্সজুড়ে অন্তত ৯৯৪ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
পার্ক দেস প্রিন্সেস স্টেডিয়ামের বাইরে প্যারিস রিং রোডে বিক্ষোভের সময় এক ব্যানারে লেখা ছিল, ‘আল্লাহ তাকে রহম করুন।’
নাহেল হত্যার ন্যায়বিচার চেয়ে ফ্রান্সের আরেকটি শহরে এক তরুণ বলেন, ‘পুলিশের সহিংসতা এখানকার নিত্যদিনের ঘটনা। বিশেষ করে আপনি যদি আরব বা কৃষ্ণাঙ্গ হন।’
তবে নাহেলের পরিবারের আইনজীবী বলেন, এটা শুধু বর্ণবাদের বিষয় নয়, এখানে ন্যায়বিচারের বিষয়টিও রয়েছে। আইনজীবী ইয়াসিন বলেন, ‘আমাদের এমন আইন ও বিচারব্যবস্থা আছে, যা পুলিশ কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেয়। এর মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে দায়মুক্তির সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।’