ব্রিটেন শোকে স্তব্ধ। তাঁদের অতি আপনজন, সবচেয়ে প্রিয় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে চিরদিনের জন্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিদায় জানাতে হল। সোমবার দিনটা তাই পুরো ব্রিটেন তো বটেই, কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলো এবং বিশ্বের হৃদয়বান মানুষের কাছে ছিল মর্মভেদী এক শোকের দিন।
এদিন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে রানী এলিজাবেথকে বিদায় জানিয়েছে রাজপরিবার, বিশ্বনেতারা ও সাধারণ মানুষজন। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলে ব্রিটেনের নতুন রাজা তৃতীয় চার্লস ও পরিবারবর্গ। তিনি রাজা। তবু কাঁদলেন। তাঁর অভিব্যক্তি, তাঁর বাচনভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল কী পরিমাণ ক্ষরণ হচ্ছে তাঁর হৃদমাঝারে।
রাজা একা নন। পরিবারের সবার মধ্যেই কান্না, কষ্টের এক নীল যন্ত্রণা প্রতিটি মুহূর্তে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। সামনে মায়ের মৃতদেহ, কিছুক্ষণ পর তাঁকে চিরদিনের জন্য বিদায় জানাতে হবে। চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যাবেন জন্মদাত্রী। বেদনায় রানীর পাশে দাঁড়িয়ে তার ছেলেরা, মেয়ে, নাতিপুতি, তাদের সন্তানরা, বিশ্বনেতারা অব্যক্ত ভাষায় কাঁদলেন। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বিশ্বনেতাদের মধ্যে উপস্থিত থেকে রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে রানীর প্রতি যখন শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছিল, তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরা হচ্ছিল, প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন ধর্মীয় নেতারা। এ সময় পাশ থেকে বার বার ভাই ও রাজা চার্লসের দিকে নজর রাখছিলেন বোন প্রিন্সেস অ্যান। উদ্বেগ নিয়ে তিনি বার বার তাকাচ্ছিলেন চার্লসের দিকে। এ সময় রাজা চার্লসকে দেখে মনে হয়েছে, তিনিও কাঁদছেন। তাঁর চোয়ালের মাংসপেশি শক্ত হয়ে উঠেছিল বার বার। টিভি স্ক্রিনে এ দৃশ্য দেখা গেছে বেশ কবারই। নিজের কান্না এভাবেই ধরে রাখছিলেন প্রিন্সেস অ্যান। একই অবস্থা ছিল প্রিন্স অ্যানড্রুর। পার্লামেন্ট স্কয়ার দিয়ে যখন মায়ের কফিনের পেছনে তিনি হাঁটছিলেন, তখন কান্না ধরে রাখতে যেন রীতিমত যুদ্ধ করেছেন তিনি। রানীর কফিনের পেছনে পেছনে শোকযাত্রায় ছিলেন প্রিন্স উইলিয়াম ও প্রিন্স হ্যারি। তাঁদেরও চোখ ছিল সজল।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে স্মরণকালের বৃহৎ ও আবেগঘন বিদায় জানানো হয় রানীকে। রাজপরিবারের ২০০০ অতিথি ছাড়াও বিশ্বনেতারা, ভিআইপি, শত শত মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় রানীর চিরবিদায় অনুষ্ঠান। রানীর অবদানকে স্মরণ করে পালিত হয় ব্যতিক্রমী এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিদায় অনুষ্ঠান। দুই মিনিটের জন্য নীরবতা পালন করা হয় পুরো দেশে।
ওয়েস্টমিনস্টার হল থেকে রানীর কফিন নিয়ে যাওয়া হয় ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে। ঐতিহাসিক এই চার্চেই রানীর বিয়ে হয়েছিল এবং রানী হিসেবে অভিষেক হয়েছিল। তাঁর মাথায় উঠেছিল মুকুট। তিনি তাতে পরিণত হয়েছেন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালনকারী রানী। তাঁর কফিনের ওপর রাখা হয় প্রিয় মুকুট, গোলকবিশেষ (অর্ব) এবং রাজদণ্ড। তাঁর পাশেই রানী যেসব ফুল পছন্দ করতেন তা দিয়ে উপরিভাগ সাজানো হয়। সর্বোপরি একটি কার্ড স্থাপন করা হয় ফুলের ভেতর। তাতে লেখা- ‘ইন লাভিং অ্যান্ড ডিভোটেড মেমোরি। চার্লস আর’। এই চার্চেই ১৯৪৭ সালে তখনকার প্রিন্সেস এলিজাবেথ এবং প্রয়াত প্রিন্স ফিলিপ মাউন্টব্যাটেনের বিয়ের অনুষ্ঠানে স্তবগান করা হয়েছিল।
সোমবার শেষকৃত্যের ওই অনুষ্ঠানে তা পরিবেশন করা হয়। এর আগে রানীর জন্য ধর্মগ্রন্থ থেকে বাণী পাঠ করে শোনান ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস, কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারোনেস স্কটল্যান্ড। রানীকে সমাহিত করার কথা সেইন্ট জর্জ চ্যাপেলে। উইন্ডসর ক্যাসেলের ভেতরে অবস্থিত এই জর্জ চ্যাপেল। এখানেই তাঁর প্রয়াত স্বামী ডিউক অব এডিনবরা, তাঁর বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ, রানীমাতা, বোন প্রিন্সেস মার্গারিটাকে সমাহিত করা হয়েছে। তাদের পাশেই সমাহিত করা হয় রানী এলিজাবেথ। এ জন্য রানীর কফিন নিয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি থেকে শুরু হয় আরেকটি শোক মিছিল। এই শোক মিছিল আগের থেকে অনেক বড়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়। এতে দায়িত্ব পালন করে সাতটি গ্রুপ। শোক মিছিলের পেছনে পেছনে গাড়িতে ছিলেন কুইন কনসোর্ট ক্যামিলা, প্রিন্সেস অব ওয়েলস ক্যাথারিন। আর তাঁদের সামনে ছিলেন রাজা তৃতীয় চার্লস, রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা। দ্বিতীয় একটি গাড়িতে করে যান ডাচেস অব সাসেক্স মেগান মার্কেল এবং আউন্টেস অব ওয়েসেক্স সোফি। শোক মিছিলের একেবারে সামনে ছিলেন রাজকীয় কানাডীয় মাউন্টেড পুলিশের একটি দল। পথে পথে লাখো শোকার্ত মানুষ। রানীর কফিন দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁরা। আবার কেউ কান্নাকে সংবরণ করে হাততালি দিয়েও নতুন রাজা তৃতীয় চার্লস, প্রিন্সেস অ্যান, প্রিন্স অ্যানড্রু, প্রিন্স উইলিয়াম, প্রিন্স হ্যারি ও রাজপরিবারকে শক্তি যোগান দেন।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রায় ৪৫ মিনিট পরে কফিন নিয়ে শোক মিছিল পৌঁছে ওয়েলিংটন আর্চে। এটি প্রথম তৈরি হয়েছিল ১৮২০ সালে বাকিংহাম প্রাসাদে ঢোকার গেট হিসেবে। ৬ দশক পরে তা সরিয়ে বর্তমানের অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। ফ্রান্সের নেপোলিয়নকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন বৃটেনের ডিউক অব ওয়েলিংটন। তাঁর স্মরণেই ওই ফটক বানানো হয়।
এর আগে শোক মিছিল বাকিংহাম প্রাসাদ অতিক্রম করে। এই প্রাসাদটি বিশ্ববিখ্যাত। রানী এই প্রাসাদে বসেই তাঁর রাজকাজ পরিচালনা করতেন। একই সাথে ৬৭ বছর ধরে এটি ছিল রানীর প্রধান পারিবারিক আবাসস্থলও। সিংহাসনের অভিষেক হওয়ার পর থেকে ২০২০ সালে করোনা মহামারি পর্যন্ত এখানেই থাকতেন রানী। এই বাকিংহাম প্রাসাদেই তিনি তাঁর সন্তানদের মা হয়েছেন। বড় ছেলে বর্তমান রাজা চার্লস, ছোট দুই ছেলে প্রিন্স অ্যান্ড্রু এবং প্রিন্স এডওয়ার্ডের জন্ম হয়েছে এখানেই। এই প্রাসাদ যখন অতিক্রম করে রানীর কফিন, তখন হাজারো স্মৃতি উথলে ওঠে মনে। মানুষ হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। মায়ের প্রতি মানুষের এত ভালোবাসা, সমর্থন দেখে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতার আগে রাজা চার্লস অভিভূত। তিনি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন সবার প্রতি।
ব্রিটেনের সাবেক ৬ প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা
দেশটির সাবেক ৬ জন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, তেরেসা মে, ডেভিড ক্যামেরন, গর্ডন ব্রাউন, টনি ব্লেয়ার এবং জন মেজর এখনো জীবিত। গতকাল ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে তাঁরা রানীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁদের স্ত্রীরাও।
যেসব বিশ্বনেতারা ছিলেন শেষকৃত্যানুষ্ঠানে
রানী এলিজাবেথের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। এর মধ্যে আছেন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিশিষ্ট ব্যক্তি। ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের অংশগ্রহণে নেতৃত্ব দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ফার্স্টলেডি জিল বাইডেন। তাদের পাশে ছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন ও ফার্স্টলেডি ব্রিজিত ম্যাক্রন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্দা আরডেন, চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ওয়াং কিশান, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসনারো প্রমুখ। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বিশ্বের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, রাজা, প্রিন্সেসরা সমবেত হন বৃটেনে। ৭০ বছরের বেশি সময় রাজত্ব চালানো রানীকে শেষ বিদায় জানাতে এদিন কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ সমবেত হন।
সূত্র: ডেইলি মেইল। ছবি: রয়টার্স