ইরানে ইসরায়েলের হামলা, জাতিসংঘসহ ৬ দেশের নিন্দা ও উদ্বেগ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ১৩, ২০২৫, ০৪:১৪ পিএম

ইরানে ইসরায়েলের হামলা, জাতিসংঘসহ ৬ দেশের নিন্দা ও উদ্বেগ

ছবি: সংগৃহীত

ইরানে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো ধরনের সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি জাতিসংঘ মহাসচিব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর ইসরায়েলি হামলা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। কারণ এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা চলছে। উভয়পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখাতে হবে। 

সৌদি আরব এক বিবৃতিতে বলেছে, ভ্রাতৃপ্রতিম ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ওপর ইসরায়েলের স্পষ্ট আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানাই। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও বিধান লঙ্ঘনের সামিল। যখন সৌদি আরব এই জঘন্য হামলার নিন্দা জানাচ্ছে, তখন এটি একইসঙ্গে পুনর্ব্যক্ত করছে যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এ আগ্রাসন অবিলম্বে বন্ধ করার গুরুদায়িত্ব রয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং বলেছেন, ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধিতে অস্ট্রেলিয়া উদ্বিগ্ন। এটি এমন একটি অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করার ঝুঁকি তৈরি করছে, যা ইতিমধ্যেই অস্থির। আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি, যেন তারা এমন কোনো পদক্ষেপ বা বক্তব্য থেকে বিরত থাকে যা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলবে। আমরা সবাই বুঝি, ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে, এবং আমরা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই, তারা যেন সংলাপ ও কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেয়।

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক আলোচনার মধ্যস্থতাকারী ওমান ইসরায়েলি হামলাকে বিপজ্জনক ও বেপরোয়া উত্তেজনা বৃদ্ধির কাজ হিসেবে বিবেচনা করছে। দেশটি বলেছে, এমন হামলা জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের মূলনীতিগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ধরনের আগ্রাসী ও ধারাবাহিক আচরণ গ্রহণযোগ্য নয়। এটি আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তাকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। ওমানের সুলতান ইসরায়েলকে এই উত্তেজনা ও এর পরিণতির জন্য দায়ী মনে করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান যেন তারা এই বিপজ্জনক পথ অবিলম্বে থামাতে একটি সুস্পষ্ট ও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টোফার লাকসন বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে এটি একটি সত্যিকারের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি। ভুল হিসাবের ঝুঁকি এখানে খুব বেশি। ওই অঞ্চলের আর কোনো সামরিক পদক্ষেপ বা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি প্রয়োজন নেই।

জাপানের মুখ্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব ইয়োশিমাসা হায়াশি বলেন, জাপান পরিস্থিতির আরও অবনতি ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সব কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি জাপানি নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিচ্ছে।

ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইন্দোনেশিয়া ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। এই হামলা বিদ্যমান আঞ্চলিক উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং একটি বিস্তৃত সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। সব পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন করতে হবে এবং এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, যা উত্তেজনা বাড়াতে বা আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।

ইরান যেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বা কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু না করে: মার্কো রুবিও

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, শুক্রবার রাতে, ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে একতরফাভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে। আমরা ইরানের বিরুদ্ধে এই হামলায় জড়িত নই। আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে অঞ্চলে অবস্থানরত মার্কিন বাহিনীগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আমি স্পষ্ট করে বলছি, ইরান যেন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বা কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু না করে।

ইসরায়েল নিজেই নিজের জন্য একটি করুণ পরিণতির পথ তৈরি করেছে: ইরান

ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। তিনি বলেছেন, এই হামলা ইসরায়েলের ‘বর্বর স্বভাবের প্রমাণ। ইসরায়েলকে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এই হামলার মাধ্যমে ইসরায়েল নিজেই নিজের জন্য একটি করুণ পরিণতির পথ তৈরি করেছে, যার ফলাফল তারা নিশ্চিতভাবেই ভোগ করবে।’

এদিকে ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইরান। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানাতে আহ্বান জানিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, এই হামলা ‘বিশ্ব নিরাপত্তাকে অভূতপূর্ব হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে’। এতে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যাকে তারা ইসরায়েলের প্রধান সমর্থক বলে অভিহিত করে এই হামলার পরিণতির জন্য দায়ী থাকবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগে বলেছিল যে, তারা এই হামলায় জড়িত ছিল না।

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের মুখপাত্র আবুলফজল শেখারচি বলেন, ‘এ হামলার জবাব অবশ্যই ইরানি সশস্ত্র বাহিনী দেবে। ইসরায়েলকে তার হামলার চড়া মূল্য দিতে হবে এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর কঠোর জবাবের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’

এদিকে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র রয়টার্সকে বলেছে, ‘ইসরায়েলের হামলার জবাব হবে কঠোর ও ফলাফল নির্ণায়ক।’

জরুরি অবস্থা জারি ইসরায়েলে

ইরানে হামলার পরপরই নিজ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছে ইসরায়েলি সরকার। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘খুব শিগগিরিই ইসরায়েলের ওপর পাল্টা হামলা’ চালাতে পারে ইরান। ইরানের ওপর যখন হামলা চালানো হয় ইসরায়েলের মানুষ তখন ঘুমাচ্ছিলেন। জেরুজালেমে অবস্থানরত একজন বিবিসি সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সাইরেনের বিকট শব্দে এবং মোবাইলে জরুরি সতর্কবার্তা পেয়ে তারা জেগে ওঠেন।

ইরানের স্থানীয় সময় ভোর ৪টার দিকে তেহরানে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এর কিছু সময় পর, তেহরানে তখন ভোর ৫টা ৩০ মিনিট এবং ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান শহর তেল আবিবে ভোর ৫টা, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

ইরানে ইসরায়েলি হামলার বিষয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘যতদিন প্রয়োজন, ততদিন এ হামলা অব্যাহত থাকবে। এই হামলা ইরানের পরমাণু সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচির কেন্দ্রে আঘাত হেনেছে।’ শুক্রবার হামলার পর এক ভিডিও বিবৃতিতে তিনি আরও বলেন, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছে।

নেতানিয়াহু বলেন, ‘ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য’ ইরানি হুমকি প্রতিহত করতে সামরিক অভিযান ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ শুরু করেছে ইসরায়েল। রাজধানী তেহরান থেকে ২২৫ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর নাতানজ্-এ হামলা চালানোর কথা জানান নেতানিয়াহু। এ জায়গাটিকে সমৃদ্ধকরণের মূল এলাকা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইসরায়েল ‘বোমা তৈরিতে কাজ করা’ ইরানি বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যবস্তু করেছে। এই হামলা ‘যত দিন সময় লাগে তত দিন চলবে।’

শুক্রবার ভোরে ইরানের রাজধানী তেহরানসহ একাধিক স্থানে হামলা চালায় ইসরায়েল। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী বলছে, ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। তেহরানসহ বেশ কয়েকটি স্থানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এ হামলায় ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের (আইআরজিসি) প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামিও নিহত হয়েছেন। তেহরানে আইআরজিসি সদর দপ্তরেও হামলা হয়েছে বলে জানায় ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। হামলার সময় আইআরজিসি-এর সদর দপ্তরে ছিলেন হোসেইন সালামি। এছাড়া ইরানের দুই পরমাণুবিজ্ঞানীও নিহত হয়েছেন। তারা হলেন, ফেরেদুন আব্বাসি ও মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে নিহত দুই বিজ্ঞানীর নাম প্রকাশ করা হয়েছে। 

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেরেদুন আব্বাসি ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার (এইওআই) সাবেক প্রধান। ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর দেখাশোনা করে থাকে এইওআই। ২০১০ সালে তেহরানের একটি সড়কে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। তখন প্রাণে বেঁচে যান তিনি। নিহত অপর বিজ্ঞানী মোহাম্মদ মেহদি তেহরানচি তেহরানের ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

হোসেইন সালামি ২০১৯ সাল থেকে বিপ্লবী গার্ডস বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ইরানের পরমাণু ও সামরিক কৌশল নির্ধারণে তিনি ছিলেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তার নেতৃত্বেই ইরান আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারে একাধিক সামরিক কার্যক্রম চালিয়ে এসেছে, বিশেষত ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননে।

ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডস মূলত একটি সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি যা দেশটির ইসলামি শাসন ব্যবস্থার প্রতি ভেতর ও বাইরে থেকে আসা যে কোনো হুমকিকে প্রতিরোধে কাজ করে।

বিবিসি বলছে, আইআরজিসি ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর একটি শক্তিশালী শাখা, যার রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব দেশটির ভেতরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গার্ডস বাহিনী বিশেষত ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

Link copied!