ছবি: সংগৃহীত
ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘাতে ইসরায়ে লের হামলায় ইরানের শীর্ষ কয়েকজন সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার হোসেইন সালামি, খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার গোলামালি রশিদ এবং আইআরজিসির এরোস্পেস ফোর্সের কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহ।
এমন পরিস্থিতিতে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং দেশের সামরিক কাঠামোতে বড় ধরনের রদবদল ঘটান। তিনি নতুন করে নিযুক্ত করেন সেনাবাহিনী ও IRGC-এর পাঁচজন শীর্ষ কমান্ডার, যারা কেবল অভিজ্ঞ যোদ্ধা নন, বরং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক যুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রস্তুত একটি নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব।
আবদুর রহিম মুসাভি – সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান (Chief of General Staff)
মেজর জেনারেল সাইয়্যেদ আবদুর রহিম মুসাভি, ১৯৫৯ সালে ইরানের কোমে জন্মগ্রহণ করেন, তিনি ইসলামিক রিপাবলিকের সেনাবাহিনীর একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি।
১৯৫৯ সালে কোম শহরে জন্ম নেওয়া মুসাভি ইরান-ইরাক যুদ্ধে আর্টিলারি ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন।
দীর্ঘ সামরিক জীবনে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন-
· ২০০৫–২০০৮: Joint Chiefs of Staff চেয়ারম্যান
· ২০১৭–২০২৫: সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ
· ২০২৫ সালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন
সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে তার নিয়োগ ইরানের সামরিক কমান্ডের কাঠামোর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে ধরা হচ্ছে। কারণ প্রথমবারের মতো, এই পদটি, আইআরজিসি কমান্ডারদের বাইরের কাউকে দেওয়া হয়েছে। পূর্বে আইআরজিসি কমান্ডাররাই এই পদে নিয়োগ পেতেন।
মোহাম্মদ পাকপুর – IRGC কমান্ডার-ইন-চিফ
১৯৬১ সালে আরাক শহরে জন্মগ্রহণকারী মেজর জেনারেল মোহাম্মদ পাকপুর ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি)-এর একজন অভিজ্ঞ কমান্ডার। যিনি কমান্ডার-ইন-চিফ নিযুক্ত হওয়ার আগে ১৬ বছর ধরে আইআরজিসির স্থল বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর আগে তিনি-
· ২০০৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত IRGC স্থল বাহিনীর প্রধান ছিলেন
· ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাঁজোয়া ইউনিটের নেতৃত্ব দিয়েছেন
· সাবেরিন ইউনিট গঠন করেন, যা সীমান্ত নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন
তিনি যুদ্ধের সময় আহতও হয়েছিলেন, মোহাম্মদ পাকপুর ক্লাসিক্যাল এবং গেরিলা যুদ্ধে মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কমান্ডারদের একজন। তিনি তেহরান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূগোলে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং তারবিয়াত মোদারেস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনৈতিক ভূগোলে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।
তিনি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ নেতার কাছ থেকে বিজয়-১ পদক পেয়েছেন এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকাভুক্ত কমান্ডারদের একজন তিনি।
আলী শাদমানি – খাতাম আল-আম্বিয়া সদর দপ্তরের কমান্ডার
ইসরায়েলি আক্রমণে গোলামালি রশিদ নিহত হওয়ার পর হামেদান শহরে জন্মগ্রহণকারী আলী শাদমানিকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত করা হয় এবং খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।
ইরানি গণমাধ্যমের মতে, আলী শাদমানি ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে মাশহাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমাটোলজির ছাত্র ছিলেন, পরে তিনি স্কুল ছেড়ে দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। বিপ্লবের শুরুর দিকে, তিনি চাকরি ছেড়ে হামাদানে বিপ্লবীদের সাথে যোগ দেন। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন তিনি-
· ইরান-ইরাক যুদ্ধে ৩২তম ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন
· পরবর্তীতে IRGC স্থলবাহিনীর অপারেশন প্রধান, হামজা স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডারসহ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন
· প্রায় ৯ বছর খাতাম আল-আম্বিয়া ঘাঁটির ডেপুটি ছিলেন, এরপর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন
· খাতাম আল-আম্বিয়া কেন্দ্রীয় সদর দপ্তরের কমান্ডার
শাদমানি ১০ বছর আগে সিরিয়ায় নিহত আইআরজিসির শীর্ষ কমান্ডার হোসেইন হামেদানির সাথে কাজ করেছিলেন।
আমির হাতামি – সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ
আমির হাতামি, ১৯৬৬ সালে জানজানে জন্মগ্রহণ করেন, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানির দ্বিতীয় মেয়াদের প্রশাসনে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
ইরানি মিডিয়া অনুসারে, তিনি অল্প বয়সে ইরান-ইরাক যুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি-
· ২০১৭–২০২১: প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন
· ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন
· সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং জনশক্তি বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন
২০১০-এর দশকে, হাতামি ইরানের ১১তম সরকারে উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ১২তম সরকারে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদে উন্নীত হন এবং আইআরজিসির অধীনে বহু বছর ধরে এই পদে দায়িত্ব পালনের পর সেনা কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন।
সামরিক দায়িত্বের পাশাপাশি, হাতামি আর্মি কমান্ড-অ্যান্ড-স্টাফ ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতাও করেন। ২০২২ সালের অক্টোবরে, কানাডিয়ান সরকার “মানবাধিকার লঙ্ঘন” এর দায়ে অভিযোগ তোলে এবং আমির হাতামির উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
মাজিদ (হোসেইন) মুসাভি – IRGC এরোস্পেস ফোর্সের প্রধান
মাজিদ মুসাভি নামে পরিচিত হোসেইন মুসাভি ইফতেখারি তেহরানে জন্মগ্রহণ করেন এবং তিনি বিপ্লবী গার্ডের একজন অভিজ্ঞ কমান্ডার। এর আগে তিনি-
· আইআরজিসি এরোস্পেস ফোর্সের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ইরানি মিডিয়া অনুসারে, তিনি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন সিস্টেম এবং মহাকাশ সরঞ্জামের নকশা, উন্নয়ন এবং বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন কর্মসূচির উন্নয়নে তার সরাসরি ভূমিকার জন্য হোসেইন মুসাভি ইফতেখারির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।