ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কেন ইভিএম নয়? যেভাবে হয় ভোটগ্রহণ

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুলাই ১৯, ২০২২, ১২:২৩ এএম

ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কেন ইভিএম নয়? যেভাবে হয় ভোটগ্রহণ

ভারতের ১৫তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শেষে হলে বৃহস্পতিবার এই নির্বাচনের গণনা হওয়ার কথা। এবারে রাষ্ট্রপতি হওয়ার দৌড়ে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু এবং কংগ্রেস, তৃণমূল, বাম-সহ বিরোধী শিবির সমর্থিত প্রার্থী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিন্‌হা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)’-এ হয় না। এক্ষেত্রে শুধু ব্যালট পেপারেই নেয়া হচ্ছে ভোট।

আরও পড়তে পারেন-ভারতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন: দ্রৌপদী মুর্মুর পাল্লাই ভারী

ভারতের সংবাদমাধ্যম আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৪ সাল থেকে শুরু করে মোট চারটি লোকসভা নির্বাচন এবং ১২৭ টি বিধানসভা নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ভারতের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, রাজ্যসভার সদস্য এবং রাজ্য বিধান পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করার জন্য ইভিএম ব্যবহার করা হয় না।

ইভিএম এমন একটি প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে, যেখানে এই মেশিনগুলি ভোটের সমষ্টি গণনা করতে সাহায্য করে। ভোটাররা ইভিএম-এ তাঁদের পছন্দের প্রার্থীর নামের পাশের বোতাম টিপে ভোট দেন। নির্বাচন শেষে কোন প্রার্থী কত ভোট পেয়েছেন তা হিসেব কষে বের করে দেয় এই যন্ত্র।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোট কেন ইভিএম-এ নয়

লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা এবং পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক জন ভোটার ভোট দিতে পারেন এক জন প্রার্থীকেই। তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে হিসেব কিন্তু এত সোজা নয়।

ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয় গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এক জন ভোটদাতা চাইলে এক জনের বেশি প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। তবে প্রার্থীদের মধ্যে প্রথম পছন্দ কে তা-ও ভোট দেওয়ার সময় জানাতে হয় ওই ভোটদাতাকে।

ভোটদাতা প্রথম পছন্দ জানানোর পর তবেই তাঁর ব্যালট পেপার বৈধ বলে গণ্য হয়। ভোটারদের পছন্দ করা অন্য প্রার্থীদের ঐচ্ছিক হিসেবেই ধরা হবে। তবে চাইলে কোনও ভোটাদাতা এক জন প্রার্থীকেও পছন্দের প্রার্থী হিসেবে বেছে নিতে পারেন।

লোকসভা এবং রাজ্যসভা সাংসদদের পাশাপাশি ভারতের ২৮টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিল্লি ও পুদুচেরি বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যেরাও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেন। তবে প্রত্যেক ভোটারদের ভোট মূল্যও আলাদা আলাদা। কারও ৭ তো কারও ২০৮। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে, সোজাসাপ্টা গণনার ইভিএমে এই পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণের হিসেব কষা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার আরও জটিল হিসেব কষার যন্ত্র।

চালু ইভিএমে এক জন ভোটদাতা চাইলেও একের অধিক প্রার্থীকে কখনই ভোট দিতে পারেন না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এক জনের ভোটমূল্য একের অধিক। পাশাপাশি ভোট দেওয়া যায় একাধিক প্রার্থীকে।

ইভিএম নির্মাতারা ব্যাখ্যা করেছেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা ভেবে এই যন্ত্র তৈরি করা হয়নি। তবে ভবিষ্যতে এমন কোনও যন্ত্র তৈরি করা হবে কি না সেই উত্তরও অজানা।

তাই হিসেবের জটিলতার কথা মাথায় রেখে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, রাজ্যসভার সদস্য এবং রাজ্য বিধান পরিষদের সদস্যদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে এখনও ব্যালটেই ভরসা রেখেছে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট অনুসারে, ১৯৭৭ সালে হায়দরাবাদের ‘ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইসিআইএল)’-কে ইভিএম তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ইভিএম ব্যবহার করে প্রথম ভোটগ্রহণ হয় ১৯৮২ সালে। কেরলের পারাভুর উপনির্বাচনে। পঞ্চাশটি ইভিএম ব্যবহার করে এই ভোটগ্রহণ হয়। ফলাফল ঘোষণার পর পরাজিত প্রার্থী আদালতের দ্বারস্থ হন। অভিযোগ করেন, এই মেশিনের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ বেআইনি। আদালতের নির্দেশ অনুসারে আবারও পেপার ব্যালটে ভোটগ্রহণ শুরু হয়।

এর পর আবার ১৯৯৮-এ পরীক্ষামূলকভাবে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং দিল্লির ২৫ টি বিধানসভা আসনে এই মেশিন ব্যবহার করে ভোটগ্রহণ হয়।

যেভাবে হয় ভোটগ্রহণ

লোকসভা এবং রাজ্যসভা সাংসদদের পাশাপাশি ভারতের ২৮টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিল্লি ও পুদুচেরি বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যেরাও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেন। নয়া কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরে এখনও বিধানসভা গঠিত হয়নি।

লোকসভার নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ৫৪৩। রাজ্যসভার নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ২৩৩। তবে এখন রাজ্যসভায় ৫টি আসন খালি রয়েছে। ৩০টি বিধানসভার মোট বিধায়কের বর্তমান সংখ্যা ৪,১২৩।

দেশের বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে লোকসভা ও রাজ্যসভায় নির্বাচিত প্রত্যেক সাংসদের ভোটমূল্যই সমান— ৭০৮।

সাংসদ এবং বিধায়কদের সম্মিলিত ভোটমূল্য ১০ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮২। সাংসদ ও বিধায়কদের সম্মিলিত ভোটমূল্য প্রায় সমান। কয়েকটি আসন খালি থাকায় এ বার মোট ভোটমূল্য ১০ লক্ষ ৮১ হাজার ৯৯১।

বিধায়কদের সম্মিলিত ভোটমূল্য ৫ লক্ষ ৪৯ হাজার ৪৭৪। সাংসদদের সম্মিলিত ভোটমূল্য সেটা ধরে নিয়ে ওই সংখ্যাকে মোট সাংসদ সংখ্যা (৭৭৬) দিয়ে ভাগ করা হয়। ভাগফলকে নিকটবর্তী পূর্ণ সংখ্যায় নিয়ে গেলে প্রত্যেক সাংসদের ভোটমূল্য দাঁড়ায় ৭০৮।

দেশের বিভিন্ন রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে লোকসভা ও রাজ্যসভায় নির্বাচিত প্রত্যেক সাংসদের ভোটমূল্যই সমান— ৭০৮। কিন্তু বিভিন্ন রাজ্যের বিধায়কদের ভোটমূল্যে রয়েছে গুরুতর তারতম্য।

ভোটমূল্যের হিসাবে শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ। সে রাজ্যের এক জন বিধায়কের ভোটমূল্য ২০৮। পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেক বিধায়কের ভোটমূল্য ১৫১। সবচেয়ে কম ভোটমূল্য সিকিমের বিধায়কদের। মাত্র ৭!

অর্থাৎ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনও প্রার্থী যদি সিকিমের মোট ৩২ জন বিধায়কের সকলেরই ভোট পান, তা হলেও তাঁর ঝুলিতে যাওয়া ভোটের মূল্য হবে ২২৪। উত্তরপ্রদেশের ১ জন বিধায়কের ভোটমূল্যের চেয়ে সামান্য বেশি!

১৯৭১ সালের জনগণনার রিপোর্টকে ভিত্তি করে সাংসদ ও বিধায়কদের ভোটমূল্য নির্ধারিত হয়। ২০২৬ সাল পর্যন্ত ওই জনগণনার ভিত্তিতেই সাংসদ ও বিধায়কদের ভোটের মূল্য নির্ধারিত হবে। তার পর হতে পারে নতুন মূল্যায়ন।

যে কারণে আপাতত সোমবার এই পদ্ধতিতেই ভোটগ্রহণ হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ভোট দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ-সহ কেন্দ্র ও রাজ্যের লোকসভা ও বিধানসভার সদস্যরা।

Link copied!