শীতকালীন হামলায় কতটুকু সাফল্য পাচ্ছে রাশিয়া?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৩, ১১:০৪ পিএম

শীতকালীন হামলায় কতটুকু সাফল্য পাচ্ছে রাশিয়া?

রুশভাষীদের ‘বাঁচানোর’ ধুয়া তুলে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। কয়েক মাসের মধ্যে খারকিভ ও খেরসনসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চল দখল করে নেয় রুশ বাহিনী। তবে গত বছরের মে মাসের পর আর বড় ধরণের উল্লেখযোগ্য অভিযান পরিচালনা করেনি তারা। ওইসময় ফ্রন্টলাইন স্থির রাখাই ছিল রুশ সেনাদের একমাত্র লক্ষ্য।

তবে সেই সুযোগের দারুণ ব্যবহার করেছে ইউক্রেন। রাশিয়ার দখলে থাকা খারকিভ ও খেরসন অঞ্চলের বহু এলাকা ইউক্রেনিয় সেনারা ছিনিয়ে নিয়েছে। এমতাবস্থায় রুশ সেনাবাহিনীর লক্ষ্য স্থির হয় শীতকালে তারা বড় ধরেণের অভিযানে নামবে। স্বয় দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও তাঁর নিজের ক্লান্ত সেনা এবং জেনারেলদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘তোমরা শুধু আমাকে ক্রিসমাস পর্যন্ত নিয়ে যাও। শীত আমাদের বন্ধু।’

কেন শীতকালে হামলা জোরদার করলো রুশ বাহিনী?

রুশ প্রেসিডেন্ট ভেবেছিলেন শীতে ইউরোপে তুলনামূলকভাবে বেশি ঠাণ্ডা পড়লে বৈশ্বিক তেল ও গ্যোসের সরবরাহে টান পড়বে। এর ফলে দাম স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হবে। পাশাপাশি জ্বালানি ঘাটতির কারণে যদি ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে বিদ্যুৎ–বিভ্রাট শুরু হয়, তাহলে ভুক্তভোগী ন্যাটোর ইউরোপীয় দেশগুলো ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে রাশিয়ার যেকোনো শর্তে রাজি হয়ে যুদ্ধ থামাতে চাপ দিতে পারেন।

এমন ধারণা করেই সম্ভবত রাশিয়ার সেই উইন্টার অফেন্সিভ (শীতকালীন হামলা) পুরোদমে শুরু হয়। চলতি বছরের শুরু থেকেই ইউক্রেনের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ সোলেদার শহর দখল করে নেয় রুশ বাহিনী। দনেতস্ক অঞ্চলের এই শহরে  ইউক্রেনের ফ্রন্টলাইন সব থেকে শক্তিশালী।  শুধু তাই নয়, সোলেদারের পর এবার বাখমুতকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে রুশ বাহিনী এবং এটি খুব শিঘ্রই রুশ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যেতে পারে।  

সোলেদারের পর বাখমুত হচ্ছে রুশ সেনাদের অন্যতম প্রধান টার্গেট। ইউক্রেনীয় সেনাদের পালানোর জন্য একটি রাস্তা খোলা ছিল। ওটি রুশ  বাহিনীর দখলে চলে যাওয়ায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে বাখমুত।

পুতিন প্রশাসন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দনেতস্ক এলাকার পুরোপুরি দখল নেওয়ার চেষ্টা করছে। দখলকৃত ক্রিমিয়া উপদ্বীপের সঙ্গে স্থল করিডর বিস্তৃত করতে দক্ষিণাঞ্চলেরও নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় রুশ বাহিনী। এজন্য তীব্র হামলা চালাচ্ছে তারা।

সোলেদার দখলে নেওয়ার ঘটনাকে রুশ বাহিনীর বড় ধরণের সাফল্য হিসেবে ধরা হয়। কেননা শীত শুরুর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে ব্যর্থতার বাইরে কোনো সুখবর ছিল না। এদিক দিয়ে সোলেদার  দখলে নেওয়া  রুশ বাহিনীর জন্য ‘সান্ত্বনা পুরস্কারের’ চেয়ে বেশি কিছু।

এদিকে, শীতের তীব্রতার মধ্যেও জাপোরিঝিয়া অঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকাই রাশিয়ার অধীনে। তবে বেশ কয়েকটি বড় শহর এখনো ইউক্রেনের অধীনে রয়ে গেছে। রুশ বাহিনী এখন তাই জাপোরিঝিয়ার রাজধানী শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ওরিখিভ এবং হুলিয়াপোল শহর দখলে এগিয়ে যাচ্ছে। রাজধানী এখনো ইউক্রেনের অধীনেই রয়েছে। রোগভের ভাষায়, ফ্রন্ট এখন সচল। যুদ্ধ চলছে, সবকিছু আমাদের (রাশিয়ার) হাতে রয়েছে।

তবে  রুশ বাহিনী দাবি করেছে, জাপোরিঝিয়ায় অফেন্সিভ শুরুর পর তারা সুবিধাজনক লাইনগুলো দখল করেছে। চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে ওরিখিভ দখলে আক্রমণ শুরুর ঘোষণা দেওয়ার পর দনিপার নদীর তীরবর্তী লোবকোভ গ্রাম নিয়ন্ত্রণে নেয় রাশিয়া।

এদিকে দনেতস্ক ও জাপোরিঝিয়ায় রাশিয়ার অগ্রসর নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে ইউক্রেন। জেলেনস্কি প্রশাসন বারবার বলছে, শীতে রাশিয়াকে থামানোর জন্য যথেষ্ট অস্ত্র নেই তাদের কাছে। তাদের দরকার ট্যাঙ্কসহ অত্যাধুণিক যুদ্ধাস্ত্র। জেলেনস্কি সরকারের আহবানে সাড়া দিয়ে ইউক্রেনে এরই মধ্যে ট্যাঙ্ক পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র,জার্মানি ও ইউরোপের একাধিক দেশ। রাশিয়ার তীব্র হামলার মধ্যে তারা দ্রুত অস্ত্র ও ট্যাঙ্ক পেলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যাবে বলে দাবি করেছে ইউক্রেনিয় সেনাবাহিনী।

চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস জানিয়েছেন, জার্মানি ইউক্রেনকে ১৪টি লেপার্ড ২ ট্যাঙ্ক দেবে। তার সুরে সুর মিলিয়ে ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, তারা ৩১টি অত্যন্ত শক্তিশালী ও অত্যাধুনিক আবরাম ট্যাঙ্ক ইউক্রেনকে দেবেন। ট্যাঙ্কের নিশ্চয়তা আদায় করার পর জেলেনস্কি প্রশাসনের নজর এখন ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয় দেশগুলোর অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের দিকে।

তবে এখন পর্যন্ত ব্রিটেন ছাড়া যুদ্ধবিমান দিতে কোনো দেশ রাজি হয়নি। স্থানীয় সময় বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি)  ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের সাথে বৈঠক করেন। ওই বৈঠক শেষে   যৌথ সংবাদ সম্মেলনে কিয়েভকে যুদ্ধবিমান সরবরারের প্রতিশ্রুতি দেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী।

তবে এতে বেজায় চটেছেন পুতিন প্রশাসন। ইউক্রেনে যুদ্ধবিমান পাঠালে তা ইউরোপ এবং অন্য দেশগুলোর জন্য সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চরম প্রভাব ফেলবে-এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাশিয়া। 

বর্তমানে শীতকালীন যুদ্ধে বেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে রুশ বাহিনী। পশ্চিমা দেশগুলো থেকে ট্যাঙ্ক ও যুদ্ধবিমান আসার আগেই তারা বিরাট সাফল্য পাওয়ার আশায় বড় ধরণের অভিযান শুরু করেছে। তাদের টার্গেট শীতকাল থাকতেই ইউক্রেন বাহিনীকে গুড়িয়ে দেওয়া।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি যখন রাশিয়া আক্রমণ করে তখন রুশ বাহিনী পেরে ওঠেনি। হিটলারের বাহিনী রাশিয়ার অনেক অঞ্চল দখল করে নেয়। রুশ বাহিনী ওই সময় ধীরে ধীরে প্রতিরোধ গড়ে তুলে শীতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। শীত আসার পরই প্রচণ্ড হামলায় জার্মান বাহিনী পিছু হটতে থাকে। একসময় সীমানা থেকে বের করে দেয় তাদের।

মাকিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শীতকালে রুশ সেনারা যুদ্ধ করতে বেশি পছন্দ করে। এসময়ে তাদের মনোবল দ্বিগুণ হয়ে যায় এবং যুদ্ধক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তবে এর কারণ অবশ্য জানা যায়নি। বর্তমান পুতিন প্রশাসনও তাই শীতে ইউক্রেনকে মরণ কামড় দিচ্ছে বলে আন্তর্জাতিক ও যুদ্ধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন।  

Link copied!