বিস্ফোরক দ্রব্য থেকে শুরু করে মানি লন্ডারিং- সবই চলছে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে। তার সাথে চলছে বিভিন্ন রাসায়নিক কেমিক্যাল, আগ্নেয়াস্ত্রসহ মাদকের দ্রব্য পরিবহন। এমনকি অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের মাধ্যম হিসেবে কুরিয়ারকে বেছে নিচ্ছে অপরাধীরা। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কুরিয়ার সার্ভিসের এমন বেপরোয়া কার্যকলাপকে বড় ঝুঁকি হিসেবে দেখছে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
আর্থিক লেনদেনে শনাক্তের উপায় নেই
আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য আর্থিক লেনদেন মাধ্যম হিসেবে অনেকেই বেছে নিয়েছেন কুরিয়ার সার্ভিসকে। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কালো টাকা বা অবৈধ টাকা পাঠালে প্রেরক কিংবা প্রাপক কাউকেই সহজে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। ফলে অপরাধী থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। যদিও ২০০৪-এ এ সংক্রান্ত একটি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সেসময় কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশনকে নোটিশ দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নোটিশে বলা হয়, কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন নগদ অর্থ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রেরণের মাধ্যমে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। পোস্ট অফিস অ্যাক্টের ৪ ধারামতে পোস্ট অফিস ব্যতীত কুরিয়ার সার্ভিস এটি করতে পারে না। দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অর্থ স্থানান্তর সম্পর্কিত আইন রয়েছে দুটি। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এবং ডাকঘর আইন, ১৮৯৮। এই দুই আইনেই কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানি অর্থ স্থানান্তর করতে পারে না। ডাকঘর আইনের আওতায় সর্বশেষ মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা করা হয় ২০১৩ সালে। এতেও অর্থ স্থানান্তরের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানিগুলোকে।
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকও কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের নজরদারি রাখার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে অনেকটা ঝুঁকির মধ্যেই চলছে এই ধরনের লেনদেন।
বিস্ফোরণ-মাদক বহনের সহজ মাধ্যম
কুরিয়ারের মাধ্যমে শুধু অর্থ স্থানান্তরই নয়, নিষেধাজ্ঞা রয়েছে বিস্ফোরক ও রাসায়নিক কেমিক্যাল পদার্থ পরিবহনেও।এক্ষেত্রেও রয়েছে আলাদা আলাদা আইন তবুও দেদারসে চলছে বিস্ফোরক বা দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ ও পরিবহন। আর ঘটছে দূর্ঘটনা। ৯ অক্টোবর কাকরাইলে আতশবাজি, বেকারি কাঁচামাল, এগ্রো কেমিক্যাল, অ্যালুমিনিয়াম ও ক্যালসিয়াম ফসফরাইডসহ একাধিক দাহ্য ও বিস্ফোরকসম্পৃক্ত অনেক কিছু এস এ পরিবহন কুরিয়ারে ছিল অরক্ষিত। ফলে সকাল ১০টার পরেই ঘটেছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করলেও আতশবাজি ও এগ্রোর ম্যাটেরিয়েল থেকে বার বার ঘটছিল বিস্ফোরণ। অথচ ১৮৮৪ সালের ৪নং অ্যাক্টে বিস্ফোরক তৈরি, অধিকারে রাখা, ব্যবহার, বিক্রয়, পরিবহন ও আমদানি নিয়ন্ত্রণ আইনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে, কুরিয়ার সার্ভিস কোনোভাবেই দাহ্য পদার্থ, কেমিক্যাল, আতশবাজি, নাইটো গ্লিসারিন, ডিনামাইট এসব পরিবহন বা সংরক্ষণ করতে পারবে না।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনালজি বিভাগের চেয়ারম্যান শাহরিয়া আফরিন জানান, নির্বাচনকে ঘিরে অপরাধীরা নানারকম কৌশল অবলম্বন করে। যদি কুরিয়ার সার্ভিস পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও প্রেরক প্রাপকের সুনির্দিষ্ট তথ্য রাখতে না পারে তাহলে এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত নয়। যদি কোন লেনদেনকে সন্দেহজনক মনে হয় তাহলে সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া উচিত। আর বিভিন্ন রকম কেমিক্যাল ও দাহ্য পদার্থ পরিবহন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন করা আছে সেগুলো অনুসরণ করা উচিত। যারা আইন মান্য করবে না তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা উচিত।
কুরিয়ার সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (সিএসএবি)’র সভাপতি ও সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের সত্ত্বাধিকারী হাফিজুর রহমান পুলক দ্য রিপোর্ট ডট লাইভকে বলেন, সাধারণত আতশবাজি বা দাহ্য পদার্থ পরিবহন ও সংরক্ষণ করা নিষেধ। এছাড়া বিভিন্ন অধিদপ্তর, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণসহ বেশকিছু সংস্থারও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে আমরা সেগুলো মেনে চলার চেষ্টা করি। অনেক সময় কাস্টমার বুকিং দিতে এসে ডিকলার করে না অথবা বেআইনি পণ্য থাকলে তথ্য গোপন করে সেবা নিতে পণ্যের সঠিক বিবরণ দেয় না আমরা তো প্যাকিং খুলে নিরাপত্তা বা গোপনীয়তা নষ্ট করে কারও পণ্য ক্ষতি সাধন করতে পারি না। অনেকক্ষেত্রে স্ক্যানিংয়েও ধরা পড়ে না।
আর আর্থিক লেনদেন বা টাকা স্থানান্তরের বিষয়ে তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী অর্থ স্থানান্তর আমাদের পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। কারণ আমাদের এ বিষয়ে অনুমতি দেওয়া হয়নি তবে আমরা যে অর্থের কুরিয়ারে জড়িত তা হলো ক্যাশ অন ডেলিভারি টাকা কাস্টমারের কাছ থেকে সংগ্রহ করে বিক্রেতার নিকট পৌছানোর কাজটি করে থাকে। নির্বাচনে অর্থের লেনদেন বা কালো টাকার বাহক হিসেবে কোন কুরিয়ারের নাম আসলে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান।