জেরুজালেমের সৌন্দর্যে নিষ্ঠুরতা

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জানুয়ারি ৫, ২০২৩, ০১:২১ পিএম

জেরুজালেমের সৌন্দর্যে নিষ্ঠুরতা

গত বছর ঘটে যাওয়া এত ঘটনার মধ্যে একটি ঘটনা আমাকে নাড়া দিয়ে যায়। ক্ষমার অযোগ্য ও ভুলে যাওয়া অসম্ভব একটি ঘটনা যা পুরো বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। ঘটনাটা একই সাথে বিয়োগান্তক, নায়কোচিত একটি অধিক মাত্রায় প্রতীকী ছিল।

আমি আর আমার কলিগরা অবিশ্বাসের চোখে বিস্মিত হয়ে দেখছিলাম যেন এটা আমাদের চোখের সামনেই ঘটছে। আমরা ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। আল জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহর হত্যাকাণ্ডের তিন দিন পর, ইসরায়েল তাদের অপকর্ম আরও দ্বিগুণ করলো! শিরিনের শোকযাত্রায় তাদের নির্দেশে হামলা চালানো হলো এবং ফিলিস্তিনি রীতিতে যে শেষ বিদায় জানানোর আয়োজন ছিল, সেটিকেও ভণ্ডুল করে দেওয়া হলো।

পূর্ব জেরুজালেমে সেন্ট জোসেফ হাসপাতালের আঙিনায় শিরিনকে শেষ বিদায়ের জন্য নিয়ে যেতে শোকার্তরা কফিন নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল। তখন তাদের শবযাত্রা থামিয়ে দিতে বাধ্য করে ইসরায়েলি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শোকার্তদের ওপর হামলা চালিয়ে, লাঠিপেটা করা হয় তাদের। কফিন বহনকারীদেরও এমনভাবে আঘাত করা হচ্ছিল যে তাঁরা অনেক চেষ্টায় জীবন বাঁচাতে পেরেছে শুধু।

সেই সাহসী ফিলিস্তিনিরা মার খেয়েও কফিনকে তুলে ধরে এর পবিত্রতা বাঁচাতে চেষ্টা করছিল। বারবার ছিটকে যাওয়ার কারণে কফিনটি পড়ে যাওয়ার শঙ্কা জাগলেও তাঁরা সেটিকে শক্ত করে আগলে রেখেছিল।

এই শোকযাত্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নাগরিক যুক্ত হয়ে একে ইতিহাসের পাতায় জায়গা দেয়। তাদের জন্য ও বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষের সমর্থনে শিরিন এখন ‘মুক্তি ও ত্যাগ’-এর প্রতীক।

এই শোকযাত্রা দেখিয়েছিল শিরিনের সাংবাদিকতার জীবন কত কঠিন, নির্মম ও কষ্টে ভরা ছিল। এই কাপুরুষের মতো হামলা দেখে যদি তাঁকে রিপোর্ট করতে হতো তাহলে তিনি হয়তো আমাদের চেয়েও কম অবাক হতেন, তাঁর কাছে হয়তো আরও কম নাটকীয় লাগতো, তিনি হয়তো আরও শান্ত থাকতেন। অন্যসব কিছুর চেয়ে জাতীয় পতাকা হাতে ‘ফিলিস্তিনের মুক্তি চাই’ স্লোগান দিতে থাকা ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বেশি ভয় পায় এই শক্তিশালী পারমাণবিক দেশটি।

যদি শোকযাত্রার কারণে রাজপথ বন্ধ হয়ে যাওয়াটা প্রতিহত করাটাই ইসরায়েলি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল লক্ষ্য থাকতো তাহলে তারা শুধু সেটি না হয় তেমন ব্যবস্থাই নিত। কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনিদের আঘাত করা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সামনে অপমানিত করা। পুরো বিশ্বকে দেখানো যে ইসরায়েল যা করতে চায়, যখন যেভাবে যেখানে ইচ্ছা করতে পারে। বিশেষ করে পশ্চিমা সমর্থক ও যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকদের দেখানো যে ইসরায়েলের ওপর তারা কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না এমনকি বিশিষ্ট ফিলিস্তিন আমেরিকান সাংবাদিককে হত্যা করার পরও।

কেন? কারণ ইসরায়েল ক্ষমতার সরাবে ডুবে মাতাল হয়ে আছে, পাগল হয়ে গেছে।

উদারপন্থি পশ্চিমা অনুগ্রহ লাভের জন্য অতীতের মতোই ইসরায়েল এই নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা লুকানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল, বর্ণবাদের গায়ে ছদ্মবেশ পরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। আত্মপক্ষ সমর্থনের ধরন সবসময়ই একই রকম: আত্মরক্ষার জন্য করা হয়েছে, এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সংক্ষেপে বলতে গেলে ইসরায়েল চরম আত্মবিশ্বাস, হত্যা ও কান্নার শিল্প রচনা করেছিল। 

মারওয়ান বিশারা। জ্যেষ্ঠ রাজনীতি বিশ্লেষক, আলজাজিরা। প্যারিসের আমেরিকান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। বিশ্ব রাজনীতি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি, মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক কূটনীতিক বিষয়গুলো নিয়ে লেখালেখির কারণে সমধিক পরিচিত। 

আল জাজিরা’তে প্রকাশিত মূল ইংরেজি প্রতিবেদনটির ভাষান্তর করেছেন ফারহানা জিয়াসমিন।

Link copied!