ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২৩, ১২:৪৭ এএম
তুরস্কে ভবন নির্মাণে দুর্নীতির কারণেই ভূমিকম্পে জানমালের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মনে করছেন দেশটির কর্তাব্যক্তিরা। এরইমধ্যে ভূমিকম্পে ধসে পড়া ভবনগুলোর নির্মাণকাজ নিয়ে ওঠা প্রশ্নের মুখে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ভবনগুলো ভেঙে পড়ার জন্য দায়ী সন্দেহে শতাধিক জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি হয়েছে। কয়েক ডজন ঠিকাদারকে গ্রেপ্তারও করেছে তারা। আমাদের দেশের থেকে অনেকটাই কড়াকড়ির দেশ তুরস্কে যখন এই অবস্থা, তখন আমাদের দেশে, বিশেষ করে ঢাকার ঘিঞ্জি ভবনগুলোর কথা ভাবলে গা শিউরে উঠতে হয়। মাঝারি কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানলেও এই শহরের কী যে দশা হবে, তা চিন্তারও বাইরে!
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূতাত্ত্বিকভাবে ভূমিকম্পের দুটি উৎস কাছাকাছি থাকায় যে কোনো সময় বাংলাদেশও এ ধরনের দুর্যোগে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে আছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং বিধি মেনে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন তৈরি না করায় অনেক বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। তুরস্কে যে পরিমাণ জানমালের ক্ষতি হয়েছে, ঢাকায় ওই রকম কোনো ভূমিকম্প হলে তার চেয়েও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হবে। এরইমধ্যে গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, সিরিয়া এবং তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগ জানাচ্ছে, বাংলাদেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প হওয়ার মত দুটি উৎস আছে। সিলেট থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলের সাবডাকশন জোন এবং ডাউকি ফল্ট, যার পূর্বপ্রান্ত সুনামগঞ্জ থেকে জাফলং পর্যন্ত বিস্তৃত। এ দুটি উৎস থেকে যে কোনো সময় ভূমিকম্প হতে পারে। সাবডাকশন জোনে ইন্ডিয়া প্লেট বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। গত ৮শ থেকে হাজার বছর সেখানে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। তার মানে যে শক্তি জমা হয়ে আছে, তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে ৮ দশমিক ২ বা বেশি মাত্রায় ভূমিকম্প হতে পারে।
আর ডাউকি ফল্টের ওই এলাকায়ও চার থেকে পাঁচশ বছর কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি। সেখানে সাত থেকে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। আজ, কাল বা ৫০ বছর পর হোক, ভূমিকম্প একদিন হবেই।
ভূমিকম্পের রিটার্ন পিরিয়ড হিসেবেও বাংলাদেশ এখন ভূমিকম্পের আসন্ন ঝূঁকিতে আছে। এরপরও ভূমিকম্প মোকাবিলায় তেমন কোন প্রস্তুতি নেই বললেই চলে। তুরস্কের মতো বড় ভূমিকম্প বাংলাদেশে হলে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ঢাকায় ৬ লাখের বেশি ভবন আছে। এদের ৬৬ শতাংশই নিয়ম মেনে হয়নি, যা ঝুঁকিপূর্ণ। বড় ধরনের ভূমিকম্প যদি হয়, তাহলে ক্ষয়ক্ষতিটা এখানেই বেশি হবে। একটা বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে তখন। আমরা প্রায়শঃ পত্রিকার পাতার খবরে দেখি, এই নগরের কোনো না কোনো ভবনের ফাটল দেখা গেছে। কর্তৃপক্ষ সে ভবন সিলগালা করে দিয়েছে। মতিঝিলের মডার্ন ম্যানসনের পিলারে ২০২২ সালে ফাটল দেখা দিলে প্রাথমিক পরিদর্শনের পর ভবনটিতে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ব্যানার লাগিয়ে সতর্ক করে দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। এরকম অসংখ্য ভবন আছে যেগুলো ভূমিকম্প ছাড়াই ফাটল নিয়ে এই নগরে দাঁড়িয়ে আছে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ভূমিকম্প হলে রাজধানী ঢাকার মতো বড় শহরগুলোতে যে পরিমাণ ঝূঁকিপূর্ণ বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে সেগুলো মূহর্তেই ধসে পড়ে শহরগুলো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যার কারণে ব্যাহত হবে উদ্ধার কাজ।
এত ঝূঁকি থাকার পরও এরকম ভবন নির্মাণ বন্ধ থাকেনি, কর্তৃপক্ষ বন্ধ করতে পারেনি। এরকম ভবন নিয়ে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকা ২০০৯ সালে এক যৌথ জরিপ চালিয়েছিল। তখন তারা জানিয়েছিল, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে শহরের ৭২ হাজার ভবন মূহর্তেই ভেঙে পড়বে; এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঢাকায় সাতের বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হলে পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন তো ধসে পড়বেই, এ ছাড়া শুধু ইটের তৈরি যেসব ভবন, সেগুলো ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে। বালু দিয়ে জলাশয় ভরাট করে তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি ভবনগুলোও টিকবে না। জলাশয়ের ওপর করা ভবনগুলোর নিচের মাটি শক্ত না। ঝাঁকুনি এলে সয়েল লিকুইফিকেশন ইফেক্টের কারণে ভবন দেবে যাবে দ্রুতই।
এরই মধ্যে রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ২০১৬ সালের ৪ জানুয়ারি কেঁপে ওঠেছিল বাংলাদেশ। ওই ঘটনায় শুধু আতঙ্কেই মারা যায় ছয়জন। এভাবে ১৫ বছরে ছোট-মাঝারি ভূমিকম্পে ১৪১ বার কেঁপেছে দেশ। যখন ভূমিকম্প হয়, তখনই মানুষের মনে ক্ষণিকের ভীতি ভর করে। তৎক্ষণাৎ নড়েচড়ে বসে সংশ্নিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোও। তবে সেই তৎপরতা থেমে যায় কয়েকদিনের মধ্যেই।
বাংলাদেশে নিকট অতীতে বড় কোনো ভূমিকম্প হয়নি। এ কারণেই হয়ত বাংলাদেশের সাধারণ মানুষজন কিংবা সরকার বিষয়টি নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় না। এ কারণে প্রস্তুতিও দুর্বল রয়ে গেছে। ভূমিকম্প মোকাবিলায় এটিই সবচেয়ে বড় সমস্যা। কারণ, কেউ বিপদ সম্পর্কে সতর্ক না হলে তাকে বিপদমুক্ত করার বিপদ আছে। তুরস্ক সতর্ক ছিল। আমাদের চেয়ে তাদের প্রস্তুতিও ছিল ঢের বেশি। কিন্তু সামলাতে পারেনি। ভূমিকম্পের মতো বিপদ আগে থেকে আঁচ করা যায় না। ফলে ভবন নির্মাণে কড়াকড়ি এবং দুর্যোগ প্রস্তুতির মতো পদক্ষেপই একমাত্র ভরসা। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে যোজন যোজন দূর। তুরস্কে যেসব ভবন ভেঙে গেছে, তার মানে সেগুলোতে এনফোর্সমেন্টে প্রবলেম ছিল। আমাদের এখানে এই সমস্যা আরও প্রকট। ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর অনেক ভবন বিল্ডিং কোড মেনে করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দ্রুত দেশের লাখো বহুতল ভবনের সবক'টিকে ভূমিকম্প সহনশীল করার উদ্যোগ নিতে হবে। সেটা করার মতো কারিগরি দক্ষতা এবং সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে। তবে এ জন্য সরকারের জরুরি উদ্যোগ দরকার। সারাদেশে বড় বড় শহরে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সেখানকার বাসাবাড়ি ভূমিকম্পন সহনীয় কিনা, সেটা যাচাই করা যেতে হবে। কোনো বাসা খারাপ থাকলে মজবুত করার ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, ভূমিকম্পে ৯০ শতাংশ মানুষ মারা যায় ভবন ধসে।
উদ্ধার কাজে আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকট তো রয়েছেই, এর ওপর ঢাকার রাস্তাগুলোর যে অবস্থা, বড় ভূমিকম্প হলে অনেক এলাকায় উদ্ধার কার্যক্রম দূরের কথা, সরু রাস্তার কারণে উদ্ধারকর্মীদের ঢোকার মতো পরিস্থিতি থাকবে না। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, ঢাকায় ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন। ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা বদলে গড়ে উঠেছে।
সরকারি তরফে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশকে ভূমিকম্প সহনীয় দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে জাপানের সাথে চার দফা বৈঠক হয়েছে। একটি সমঝোতা স্মারক তৈরি হয়েছে। সেই অনুযায়ী তিন ধাপে বাংলাদেশকে ভূমিকম্প সহনীয় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ফোকাল পারসনও নিয়োগ হয়েছে। প্রথম দফায় সচেতনতা বাড়ানো হবে, দ্বিতীয় দফায় ১০০-২০০ বছরের পুরোনো ভবন ধ্বংস করে ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণ করা হবে। এ ছাড়া সম্প্রতি যেসব ভবন তৈরি হয়েছে, তা পরীক্ষা করে সংস্কার করা হবে।
সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ এলাকায় ভলান্টিয়ার দল তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ ছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার রয়েছে। বড় পরিসরে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনওইসি) করা হচ্ছে, তেজগাঁওয়ে জমিও নেওয়া হয়েছে।
ভূমিকম্পে ভবন ভেঙে গেলে মানুষ মারা যায় বেশি। তুরস্ক-সিরিয়ার মতো ভূমিকম্প আমাদের এখানে হলে সেখানকার চেয়ে আরও কয়েক গুণ বেশি মানুষ মারা যাবে। কারণ আমাদের জনসংখ্যা বেশি। বিল্ডিংকোড এনফোর্সমেন্ট আমাদের এখানে তুরস্কের চেয়ে অনেক দুর্বল। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা রাজউক এখনও পর্যন্ত শুধু স্থাপত্য নকশা দেখে ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়। ভবনের কাঠামোগত (স্ট্রাকচারাল) নকশা বাধ্যতামূলক করার সময় এসেছে।