আমার দুটি শিশুসন্তান আছে। ওদের দুজনেরই আছে শ্বাসকষ্টের সমস্যা। শীত এলে ওদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। টনসিল ও এডিনয়েড গ্ল্যান্ড ফুলে যায়। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন, ধুলাবালির দূষণ এড়িয়ে চলতে হবে। না হলে এ সমস্যা বেড়ে অ্যাজমা হয়ে যেতে পারে! কিন্তু আমি ভেবে পাই না, অপরিকল্পিত এই রাজধানী নগরীতে বসবাস করে ধুলাবালির দূষণমুক্ত একটি পরিবেশ কি আদৌ পাওয়া সম্ভব?
এরই মধ্যে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় আমার বড় সন্তানের অস্ত্রোপচার করে তার গলার এডিনয়েড গ্ল্যান্ড ফেলে দেওয়া হয়েছে। এখন সে মোটামুটি শ্বাসকষ্টের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত আছে। তবে ধুলাবালি থেকে বাঁচতে তাকে মাস্ক পরতে হয়। কিন্তু ছোট সন্তানের সমস্যা সমাধানে আর অস্ত্রোপচারের দিকে যাইনি। কারণ, অভিজ্ঞতায় দেখলাম, এটি কষ্টসাধ্য একটি অস্ত্রোপচার এবং একই সঙ্গে ব্যয়বহুলও। ফলে ছোট সন্তানের জন্য ওষুধই ভরসা করে চলেছি।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নগরী অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। এ কারণে এই শহরে বসবাস করে ধুলাবালিমুক্ত পরিবেশ কল্পনাও করা যাবে না। সংবাদমাধ্যমে কাজ করি বলে ঢাকার দূষণের কথা আমার জানা। তাই সচেতনতা হিসেবে নিজের শিশুসন্তানদের যতটা পারি ধুলাবালি থেকে সুরক্ষার চেষ্টা করি। একই সঙ্গে শীতকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শে বিশেষ কিছু ওষুধ আগে থেকেই সেবন করানো শুরু করি। কিন্তু ওষুধও এখন কাজ করতে চায় না। বারবার একই ওষুধ সেবনে এর কার্যকারিতা হয়তো কমে আসে। এবার শীতেও ওষুধ সেবন চলছিল ছোট সন্তানটির। এর পরও কাশি আর শ্বাসকষ্ট শুরু হলো ওর। চিকিৎসক বললেন, ওষুধের পাশাপাশি নেবুলাইজ করতে হবে। এতে কিছুটা কাজ করলেও শেষে অ্যান্টিবায়োটিকও ধরতে হলো! অথচ এ শীতেই ওরা যখন ১৫ দিন গ্রামের বাড়ি ছিল, এক দিনের জন্যও কাশি বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়নি। ওষুধ নিয়ে গিয়েও সেগুলো সেবন করাতে হয়নি! এর একটিই কারণ, গ্রামের বাতাস ঢাকার থেকে দূষণমুক্ত, অনেক নির্মল। যে কারণে ওদের ফুসফুস যথেষ্ট ভালো বাতাস আর অক্সিজেন পেয়েছে, যেটি এই ঢাকাতে নেই। ঢাকায় থিতু হওয়ার পর থেকে আমার নিজেরও এই শ্বাসকষ্টের সমস্যা হয়েছে। প্রায় সময় ওষুধ চলে। আমি জানি, কাশি আর শ্বাসকষ্টের কী কষ্ট। দম বেরিয়ে যেতে চায় কাশতে কাশতে। এই লেখাটি যখন লিখছি (১৪ জানুয়ারি), রাত তখন ৩টা বাজে। ওপাশের ঘরে ছোট সন্তানটি আমার অনবরত কেশে চলেছে। বাবা হিসেবে আমারও বুকটা ফেটে যাচ্ছে প্রাণপ্রিয় সন্তানের বুকফাটা কাশির সেই শব্দে। একপর্যায়ে কাশতে কাশতে সন্তানটি আমার একবার বমিও করে ফেলল!
এই যে গ্রামে গেলে আমার শিশুসন্তানদের এ সমস্যাটা থাকে না, এই ঢাকায় ফিরলেই সমস্যাটা যে বাড়ে, সারতে চায় না; এর কারণটা কী? এই কারণ বের করতে বড় কোনো গবেষণার দরকার হয় না। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ আর পানিদূষণসহ নানা দূষণের কারণে এই শহর আর বাসযোগ্য নেই। লোকে লোকারণ্য এই নগর। এ লেখায় আজ শুধু ফোকাস করতে চাই দূষণের দিকে। সাত-আট লাখ কোটি টাকার রেকর্ড বাজেট আসে ফি-বছর, তার পরও কেন এই নগরকে বাসযোগ্য করতে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ কেন নেওয়া হচ্ছে না?
মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল বলছে, শ্বাসকষ্ট আর ফুসফুসের নানা রোগী গত পাঁচ বছরের তুলনায় এখন তিন গুণ বেশি হাসপাতালে আসছে। শুষ্ক মৌসুমে রোগীর চাপ বাড়ে। এর একটি বড় কারণ ঢাকার বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণজনিত রোগে দেশে কতসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, তার কোনো সরকারি পরিসংখ্যানও নেই। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণজনিত রোগ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির শিকার গর্ভবতী মা ও শিশুরা। অটিস্টিক শিশুর জন্ম হওয়ার একটি কারণ দূষিত বায়ু। বাচ্চাদের জন্মকালীন ওজন কম হওয়ার একটি কারণও বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের কারণে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়। হাঁচি-কাশি, ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে হচ্ছে ফুসফুসের ক্যানসারও। এই ক্যানসারের বড় কারণ দূষিত বায়ু। এ ছাড়া কিডনি ও হৃদরোগের কারণও হতে পারে বায়ুদূষণ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুমান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বরাবরই ঢাকার বায়ুর মান পরীক্ষা করছে। তাদের তথ্যে দেখা যায়, কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দূষণে শীর্ষে থাকছে ঢাকা। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার ১৪ জানুয়ারি তাদের ওয়েবসাইটে জানায়, এদিন বাতাসের মান অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ওইদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ঢাকার স্কোর ছিল ২৪৭। এরপরই ছিল ভারতের দিল্লি (২০৪)।
বায়ুদূষণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর বায়ুদূষণে ৮০ হাজার মানুষ মারা যান। মানুষের গড় আয়ু তিন বছর কমছে। দূষণের কারণে বাড়ছে মানুষের বিষণœতাও। যার অর্থনৈতিক ক্ষতি জিডিপির চার ভাগেরও বেশি। ঢাকায় সারা দিনে একজন যে পরিমাণে দূষিত বায়ু গ্রহণ করেন, তা প্রায় দুটি সিগারেটের সমান ক্ষতি করে! প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়, বায়ুদূষণে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, কাশি, নিম্ন শ্বাসনালির সংক্রমণ এবং বিষণœতার ঝুঁকি। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু, বয়স্ক এবং রোগে আক্রান্তরা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ বা শ্বাসরোগে আক্রান্তরা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ।
স্বাধীনতা লাভের অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে ঢাকার অবস্থা আজও শোচনীয়। অপরিষ্কার, বসবাসের অনুপযোগী, অপরিচ্ছন্ন, দূষিত ও অসুখী শহরের তালিকার শীর্ষ সারিতে আমাদের রাজধানী শহর। স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসুবিধা, সংস্কৃতি, পরিবেশ, শিক্ষা, শিল্পায়ন, অবকাঠামোসহ ৩০টি মানদণ্ডের বিবেচনায়ও তলানিতে রয়েছে ঢাকা। হতাশার এক নগরীতে পরিণত হয়েছে এককালের তিলোত্তমা নগরী ঢাকা।
জনবসতি ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা। সরকারি হিসাবে ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৬ হাজার মানুষ বসবাস করলেও আসল সংখ্যাটা আরও বড়। হাজারো মানুষ প্রতিদিন ঢাকায় আসছেন শিক্ষা ও জীবিকার সন্ধানে। সরকারি অফিস, আদালত, ব্যাংক, পোশাক কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় ঢাকামুখী হওয়ায় আজকে এ অবস্থা। জাতিসংঘের হ্যাবিটেট প্রতিবেদনে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকার রাস্তাঘাট, যানজট, গ্যাস বা ওয়াসার পানির ব্যবস্থা কোনোটিই মেগাসিটির মতো নয়। এর ফলে বাড়ছে মাটিদূষণ, শব্দদূষণ, পানিদূষণ ও বায়ুদূষণের হার। নগরে বায়ুদূষণের হার যেভাবে বাড়ছে, নগরবাসীর জীবনে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। ঢাকামুখী জনতার ঢলের কারণও আমরা জানি। সব সুযোগ-সুবিধা এই নগরীতে বেশি। তাহলে সুযোগগুলো বাইরের প্রতিটি বিভাগে ছড়িয়ে দিলেই তো হয়। এটা বুঝতে কি বড় গবেষক হতে হয়? কিন্তু তা না, এখানেই সবকিছু করতে হবে। আমি বলছি না যে ঢাকার বাইরে কিছু হচ্ছে না, কিন্তু ঢাকার মতো কি হচ্ছে? হচ্ছে না। যার কারণেই দেশের আঠারো কোটি মানুষ ঢাকায় আসতে চাচ্ছে। আসছে। আমরা জানি, কোনো শহর ধারণক্ষমতার বেশি হলে সেই শহরের সমস্যার সমাধান সহজ নয়। তার ওপর থাকে যদি সিটি কর্র্তৃপক্ষের করাপশন, তাহলে তো কথাই নেই।
কয়েক বছর আগে পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্রিন পিস তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। বায়ুদূষণজনিত রোগে প্রতি বছরই বহু মানুষের অকালমৃত্যুও হচ্ছে। এটি গেল শুধু বায়ুদূষণের কথা। পানিদূষণ, শব্দদূষণ এবং ভূমিদূষণের কথা বাদই দিলাম। এ রকম সমস্যা বিশ্বের অনেক দেশের রাজধানীতেই আছে। সমস্যা সমাধানে অনেক দেশ তাদের রাজধানী বদল করেছে। আমাদেরও ভাবতে হবে এ বিষয়ে। আমাদের গ্রাম আর শহরের ব্যবধান অনেকটা স্বর্গ-নরকের মতো! অথচ ইচ্ছে করলেই গ্রামের সৌন্দর্য কাজে লাগিয়ে ছয় ঋতুর বিন্যাসে ঢাকাসহ এ দেশের বিভাগীয় শহরগুলো তৈরি করা যেত। প্রাকৃতিকভাবেও আমাদের সেই সুযোগ রয়েছে। ঢাকার কথাই যদি ধরি, চারপাশে নদী আছে, আছে অনেকগুলো খাল বিল-জলাশয়। তবে এর অধিকাংশই এখন বেদখল হয়ে গেছে। সেখানে এখন চলছে দূষণের আয়োজন।
এই ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ এবং ভূমিদূষণ থেকে মুক্ত করতে হবে। এসব করার জন্য সবার আগে ঢাকার জনসংখ্যার চাপ কমাতে হবে। আবার এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ঢাকামুখী জনস্রোতকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। আর এসব তখনই করা যাবে যখন ঢাকার তাবৎ সুযোগ-সুবিধা অন্য বিভাগীয় শহরেও ছড়িয়ে দেওয়া যাবে। না হয় সমস্যা সমাধানের জন্য সারা বছর পরিকল্পনা হবে, বাজেটের লাখো কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হবে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না। আর টেকসই উন্নয়ন? সে তো বহুদূরের কথা। একটি দেশের মস্তিষ্ক রাজধানীকে অসুস্থ রেখে আপনি উন্নয়ন কল্পনা করতে পারেন না।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট