ক্ষণে ক্ষণে আকাশ কালো হয়ে থেমে থেমে ঝরেছিল আষাঢ়ের বৃষ্টি। কালো মেঘের ভেতর দিয়ে রৌদ্র উঁকি দিচ্ছিল। এমন এক আষাঢ়ের বর্ষণমুখর দিনে কিংবা আকাশে মেঘেদের লুকোচুরির ক্ষণে ১৯৬৯ সালের ২ জুলাই বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও শহীদ শেখ ফজলুল হক মণি ও আরজু মণির জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ ফজলে শামস্ পরশ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে ঘাতকরা নৃশংসভাবে শেখ পরশের পিতা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুজিব বাহিনীর স্রষ্টা, বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক, ষাটের দশকের প্রারম্ভে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি এবং মাতা আরজু মণিকে হত্যা করে ঘাতকরা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার আগে বিপথগামী সেনা সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণিকে হত্যা করে। কারণ ঘাতকরা জানত, শেখ মণিকে হত্যা না করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা যাবে না।
এমন অমানবিক হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর বিরল ঘটনা। চোখের সামনে পিতা ও অন্তঃসত্ত্বা মাতাকে হত্যার ভয়াবহ দৃশ্য দেখে ছয় বছরের শেখ পরশকে পরবর্তীতে অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হয়েছে। সেই সময়ে জীবন বাঁচানোই ভয়ানক এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
দুর্বিষহ ভবঘুরে জীবন যাপন করতে হয়েছে সুদীর্ঘ সময়। কখনও পালিয়ে আত্মীয়ের বাসায় থাকতে হয়েছে। তাদের বাসা ভাড়া দেওয়া হয়নি। স্কুলে নেওয়া হয়নি ভর্তি। খেলাধুলায়ও সঙ্গী ছিল না। এমন অমানবিক আচরণ ছিল পরশ-তাপসের সঙ্গে! ভয় ও আতঙ্কের সময় পার করে ১৯৭৮ সালে বঙ্গবন্ধুর বোন তথা শেখ পরশের দাদি শেখ আছিয়া বেগম তাদের ভারতে নিয়ে যান। ফুফু রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, চাচা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ ফজলুর রহমান মারুফ তারাও তখন বিদেশে শরণার্থী।
ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড- ১৫ আগস্টের কালো রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া শেখ ফজলে শামস্ পরশ ধানমণ্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স-মাস্টার্স ও যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডো ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন।
সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত ও আজীবন নির্মোহ ব্যক্তি শেখ ফজলে শামস্ পরশ শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন। জাতীয় রাজনীতি ও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও ছাত্রদের শিক্ষা দেন আনন্দচিত্তে। তার এই আত্মত্যাগ বিরল।
জাতীয় রাজনীতির কারণে একটি শুদ্ধি অভিযানের মধ্য দিয়ে বিশেষ প্রয়োজনে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যুবলীগকে ইতিবাচক ধারায় নিয়ে যেতে শেখ ফজলে শামস্ পরশকে দায়িত্ব দেন। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে রাজনীতির দীক্ষা খুব কাছ থেকে তিনি নিয়েছেন, যদিও সরাসরি রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন।
সরাসরি রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও শেখ পরশের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, দেশরত্ন শেখ হাসিনা কী চাইছেন? সেই অনুযায়ী তিনি কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি দায়িত্ব নিয়েই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকেও অনেক বেশি সফল হয়েছেন তিনি।
সপ্তম কংগ্রেসে দায়িত্ব পাওয়ার পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে শেখ পরশ বলেন, “নেতা হিসেবে নয়, সংগঠনের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করে যাবো। যুবসমাজ যেন হেট পলিটিক্স কালচার থেকে বেরিয়ে এসে জয় বাংলার কর্মী হিসেবে কাজ করে। সম্পূর্ণ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবো।”
নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে শেখ পরশ বলেন, “যুবলীগের কর্মীদের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু কন্যার দায়িত্ব পালন। তাই প্রধানমন্ত্রীকে আমরা সহযোগিতা করবো।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনীতির জন্য আমি, আমার ভাই শেখ ফজলে নূর তাপস মা-বাবাসহ স্বজন হারিয়েছি। আমাদের বেদনা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা অনুধাবন করেন। তাই আমি রাজনীতি থেকে অনেক দূরে ছিলাম। যে মানুষ (বঙ্গবন্ধু) রাজনীতির জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করলেন, তাকে যখন ষড়যন্ত্র করে হত্যা করা হলো, তখন বেদনাহত হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা শেখ হাসিনার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাই। আমি যে দায়িত্ব পেয়েছি, আপনাদের পাশে থেকে একজন কর্মী হিসেবে তা যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করবো।”
যুবলীগ চেয়ারম্যান বলেন, “১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৫ই আগস্টের ষড়যন্ত্রের কারণে তার সেই কাজ সমাপ্ত হয়নি। আজ প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে জিরো টলারেন্সের ডাক দিয়েছেন তা আমি দ্বিতীয় বিপ্লব হিসেবে দেখি। এই কর্মসূচি সফল করার জন্য কাজ করবো। আমি যুবলীগের চেয়ারম্যান হিসেবে নয়, একজন কর্মী হিসেবে সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবো।”
যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেসে শেখ ফজলে শামস্ পরশ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছিলেন:
যুবলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে যোগ্য, দক্ষ, শিক্ষিত, সাবেক ছাত্রনেতাদের, পরিচ্ছন্ন ইমেজের ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্তি চেয়ারম্যান হিসেবে পরশের অন্যতম সাফল্য হিসেবেই দেখছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
প্রধানমন্ত্রী সফল রাষ্ট্রনায়ক দেশরত্ন শেখ হাসিনার সুখী ও সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শেখ পরশের যুবলীগ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে গেছে। এখন যুবলীগের যাত্রা শুরু স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার পর থেকেই যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ ও সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিলের নির্দেশে যুবলীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সব নেতাকর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নাগরিক সচেতনতায় মাঠে নেমেছিল। লাখো মানুষের দোরগোড়ায় যুবলীগের হাজার হাজার নেতাকর্মী খাদ্য সহায়তা দেয়। এখনও যুবলীগ নেতা থেকে শুরু করে কর্মীরা যার যার সাধ্যানুযায়ী অসহায় মানুষের পাশে রয়েছেন। করোনায় ফ্রি টেলিমেডিসিন সেবা, এ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস প্রদান করে যুবলীগ। করোনায় মৃতদেহের দাফনের ব্যবস্থা করে যুবলীগ। অসহায় কৃষকের ধান কেটে ঘরে তুলে দেয় যুবলীগ।
জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা যুবলীগের কর্মকাণ্ড তুলে ধরে বলেন, “যুবলীগ এই সংকটে দেশের বিভিন্ন স্থানে লাশ দাফনে কাজ করেছে। যুবলীগের পক্ষ থেকে ৪২ লাখ পরিবারে খাদ্যসামগ্রী দেয়া হয়েছে। কৃষকদের দুই হাজার পাঁচশত হেক্টর জমির ধান কেটে দিয়েছে। মুজিববর্ষে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। করোনায় সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ করেছে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে উদ্দেশ্য নিয়ে শেখ ফজলে শামস্ পরশকে চেয়ারম্যান করে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, এরই মধ্যে সেই সফলতা অর্জন করেছেন তিনি। যার ফলে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে যুবলীগ। সংগঠনটি তার হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরে পেয়েছে। মানবিক এমন কর্মকাণ্ডের কারণে সাধারণ মানুষের কাছে যুবলীগ আজ ‘মানবিক যুবলীগ’। বিনয়ী, নির্মোহ ও সরলতাই প্রধান পুঁজি পরশের। তিনি এরই মধ্যে তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে সবার মন জয় করতে পেরেছেন অনায়াসেই।
যুবলীগ আজ সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী একটি সংগঠন। যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠাই মূল ভূমিকা পালন করেছে। যোগ্য নেতৃত্বের জন্য বিভিন্ন ক্রাইটেরিয়া মেইনটেইন করা হয়। সাধারণ অভিযোগও সত্য প্রমাণিত হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
শেখ পরশ যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার পর প্রথম যে কাজটি করেছেন সেটা হলো তিনি পুরো সংগঠনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন। কেন্দ্র থেকে ইউনিট পর্যন্ত চেইন অব কমান্ড এর মধ্যে নিয়ে এসেছেন। ব্যানার ফেস্টুন দেওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মের মধ্যে নিয়ে এসেছেন। ঈদ থেকে শুরু করে সব উৎসবে যত্রতত্র ব্যানার ফেস্টুন ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। সব স্তরের নেতাকর্মীরা সেটা মেনেও চলছে।
পিতা শেখ মণির অনেক গুণাবলি ধারণ করেছেন তিনি। পিতা ষাটের দশকের উত্তাল রাজনীতির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর প্রধান সিপাহসালার হিসেবে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শেখ ফজলে শামস্ পরশ তার পিতা সম্পর্কে বলেন, শহীদ শেখ ফজলুল হক মণির অনুসারী ও সহকর্মীদের ভাষায়, তিনি বাংলাদেশের বিপ্লবে সংগ্রামে এক অকুতোভয় নেতা ছিলেন। সন্তান হিসেবে আমি গর্ববোধ করি যে তিনি রণাঙ্গনেও নিজে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য। মুজিবাহিনীর শীর্ষনেতাদের মধ্যে তিনিই সবার আগে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন বলে জানা যায়। ‘৭১’র ডিসেম্বরে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশে ঢোকার আগেই, ২৩ নভেম্বর জেনারেল উবানের নেতৃত্বে দেশের পূর্বাঞ্চলে শুরু হয় ‘অপারেশন ঈগল’। শেখ মণি বিএলএফের কয়েকজন সদস্য নিয়ে তাদের সঙ্গে ‘অপারেশন ঈগল’-এ যোগ দিয়ে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। জেনারেল উবানের বর্ণনায়, “অদম্য সাহসের অধিকারী স্থিরপ্রতিজ্ঞ শেখ মণি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ ভূমিতে প্রকৃত যুদ্ধের সময় আমার সঙ্গে ছিলেন। তিনি শুধু নেতা নন, তিনি সর্বোপরি একজন রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। আমাদেরও নেতা হওয়ার আগে সর্বপ্রথম কর্মীদের কাতারে যেয়ে কর্মী হতে হবে।”
জেনারেল উবান আরও লেখেন, “হালকা পাতলা গড়নের মানুষটি যেন এক জ্বলন্ত মশাল। তাদের স্বাভাবিক নেতা বলে মনে হত তাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং যেকোনও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি ছিলেন আন্তরিক, বন্ধুদের প্রতি সংবেদনশীল, আর শেখ মুজিবের একান্ত অনুরক্ত। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর একটা প্রধান শক্তির নাম শেখ ফজলুল হক মণি। শেখ মণি বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা অসম্ভব হয়ে যেত; এটা ওই ‘৭৫’র খুনিরা ভালোভাবেই জানতো। তাই তারা শেখ মণিকেই প্রথমে হত্যার পরিকল্পনা করেন।”
তিনি আরও বলেন, শেখ মণি আমাদের কাছে বিশ্বস্ততারও প্রতীক। শেখ ফজলুল হক মণি’র অনুসারী এবং সংগঠনের কর্মী হিসেবে আমরাও গর্বের সঙ্গে বুক চাপিয়ে বলতে পারি, যুবলীগের নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জন্য সর্বোচ্চ আত্মহুতি দিতে গর্ববোধ করবে। শেখ মণি যেভাবে উপলব্ধি করতেন যে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়বিচারসম্পন্ন জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কোনও বিকল্প নেই, ঠিক একইভাবে শেখ মণির উত্তরসূরি হিসাবে আমরা আজকের যুবলীগ মনে করি, একটি অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, উন্নয়নশীল ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনার কোনও বিকল্প নাই। তিনি বলেন-স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, যুব রাজনীতির মহাপ্রাণ, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক, লেখক ও সাংবাদিক বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মণি বাংলার ইতিহাসের সংগ্রাম ও সাফল্যের অসংখ্য অকাট্য দলিল রচনা করে গেছেন মাত্র ৩৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবনে।
তার লেখনী থেকে একটা ধারণা করা যায় যে, তিনি বাংলাদেশে একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রগতিশীল, বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। সেই লক্ষ্য অর্জনে আজকের প্রেক্ষাপটে আমাদের ভিন্নি ধরণের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। তাই আজ যুবলীগের মূল কাজ দুটি: একটি রাজনৈতিক এবং আরেকটি সামাজিক। রাজপথে যেমন যুবলীগ, প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করছে, তাদের জুলুম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সমুন্নত রাখা ও রক্ষার প্রশ্নেও সোচ্চার থাকতে হবে। একই সাথে সমাজিক দায়িবদ্ধতার অংশ হিসেবে সামাজিক ন্যায় বিচার কায়েম করা, ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করা ও যুবসমাজকে উদ্বুদ্ধ করা। যুবসমাজের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা ও আমাদের নেত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মানবিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা আমাদের কর্তব্য। সংগ্রামে যুবলীগে নিপীড়িত মানুষের পক্ষে, বিজ্ঞানভিত্তিক সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে নেতৃত্ব দেবে।
তিনি আরও বলেন, “বাঙালি শিল্প, সংস্কৃতিক ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটবে। একটা প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ, মর্যাদাশীল, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ শেখ মণি দেখতে চেয়ছিলেন । যে বাংলাদেশ শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞান চর্চায় সারা বিশ্বে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। যেখানে সুশাসন কায়েম থাকবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।”
রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার ওপর রয়েছে শেখ পরশের গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তার নিরন্তর ছুটে চলা। শেখ ফজলে শামস পরশ বলেছেন, “এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। তার নেতৃত্ব, দায়িত্বশীলতা, গুণ, ধৈর্য তাকে আজকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমাদের সবারই বিকল্প আছে কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কোনও বিকল্প নেই।”
শেখ পরশ বলেন, “৪৪ বছর আগে শেখ হাসিনা এই বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন বলে আমরা পেয়েছি উন্নয়ন, আমরা পেয়েছি ভোটারাধিকার, মানুষের মৌলিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই দিন কি পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। পরিবারের ১৮ জন সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করার পরেও তিনি এদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন ও এদেশের মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো উদ্ধারে জীবনের সব হুমকি ও মায়া তুচ্ছ করে আপনাদের কাছে উপস্থিত হয়েছেন।”
তিনি বলেন, “সেই বঙ্গবন্ধুই রক্তের উত্তরাধিকার হিসেবে গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে এবং এদেশের মানুষের উন্নয়নের বাহক হিসেবে তিনি সেদিন বাংলার মাটিতে উপস্থিত হয়েছিলেন। দৃপ্তকণ্ঠে সেদিন তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার তিনি করবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হয়ে না বরং একটা ন্যায়পরায়ণ সমাজব্যবস্থার সৃষ্টির মাধ্যমে। সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেছিলেন। এটা লক্ষ্যণীয়, কোনও সামারি ট্রায়ালে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়নি। সামাজিক ন্যায়পরায়ণ বিচার ব্যবস্থা বুকে নিয়ে তিনি প্রচলিত আইনেই বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেছিলেন।”
পরশ বলেন, “যেখানে সামারিক জান্তারা রাতের পর রাত মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা করেছে, ফাঁসি দিয়েছে সেই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার এই আগমন ছিল অত্যন্ত সাহসী এবং আত্মত্যাগী। সেই আগমনের বার্তা এদেশের লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত, শোষিত মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল। এদেশের জনগণ আস্তা ফিরে পেয়েছিল, স্বপ্ন দেখেছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বপ্নের বাংলাদেশ পুনরায় প্রতিষ্ঠা করার। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিল এদেশের মানুষের খেদমত করতে, এদেশের মানুষের জন্য একটা জাতি রাষ্ট্র সৃষ্টির মাধ্যমে উন্নয়নমূলক, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি।”
যুবলীগ চেয়ারম্যান বলেন, “শেখ হাসিনা ২১ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থেকেও তার সেই দৃঢ় প্রত্যয় ধরে রেখে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। যারা যুদ্ধাপরাধীদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিল, মন্ত্রী বানিয়েছিল তিনি সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছেন। এখনও চলমান রয়েছে। যার ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার ও তাদের সন্তানরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। তা না হলে এই বাংলাদেশকে পশ্চাৎপদ বাংলাদেশ হিসেবে পরিচালিত হতো।”
শেখ পরশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রখর। তিনি বলেন, “আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বাংলাদেশ হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিত। এই জন্য সেই অপশক্তিরা আবার সক্রিয় হয়েছে। যেই অপশক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট আপনারা সবাই জানেন, তা হলো মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের রাজনীতি। সাম্প্রতিককালে যুক্ত হয়েছে পরনির্ভর রাজনীতি। আজকে তারা বিদেশি শক্তির ওপর নির্ভর করে কিন্তু জনগণের ওপর নির্ভর করে না। তারা নির্ভর করে মি. লু’দের ওপর যে তাদের হাত ধরে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে। এই স্বপ্ন সেই স্বপ্ন আজকে ব্যর্থ হয়েছে, ধূলিসাৎ হয়েছে। কারণ শেখ হাসিনার সাথে রয়েছে এদেশের আপামর জনগণ।”
পিতা শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন কর্মীবান্ধব। ‘উত্তরবঙ্গ ঘুরে এলাম’ প্রবন্ধ পাঠ করলে দেখা যাবে, যতদিন শেখ মণি উত্তরবঙ্গ ছিলেন, ততদিন কর্মীদের সমস্যা সমাধান করেছেন। মঞ্চে উঠার সময়েও কর্মীদের কথা শুনছেন এবং তৎক্ষণাৎ ওখানে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধান করছেন। তেমনিভাবে তার রক্তের উত্তরাধিকার শেখ পরশও সব স্তরের নেতাকর্মীদের কথা মন দিয়ে শোনেন। সঙ্গে সঙ্গে সবার সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন। তার অফিসে সব শ্রেণির মানুষের জন্য উন্মুক্ত। ধৈর্য ধরে সবার কথা শোনেন। মিষ্টভাষী মানুষটিকে কখনও কেউ রাগতে দেখেনি। এই কারণে মানুষেরা মন দিয়ে তাদের কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।
পিতা শেখ ফজলুল হক মণি`র মত তিনি সবসময় স্পষ্টবাদী। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি তৎক্ষণাৎ দিয়ে থাকেন। সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে তিনি অবিচল থাকেন সর্বদা।
অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ শেখ পরশ। পিতার মতোই ক্ষুরধার ও তীক্ষ্ণ তার লেখনী। যুবসমাজকে নিয়ে তিনি একটি যুক্তিবাদী বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
শেখ পরশ একজন প্রথাবিরোধী বক্তা। তার পিতার মতো তিনিও বাগ্মিতায় পটু। তার বক্তব্য শোনার জন্য জনসাধারণের কৌতূহল হিংসার উদ্রেক করে। যার বক্তব্যের পঙক্তিতে পঙক্তিতে দেখতে পাই কাব্যিক ব্যঞ্জনা, অনুপ্রাস ও মাত্রাবোধের এক অপূর্ব সম্মিলন। যুক্তি দিয়ে কথা বলেন। জটিল কথাকে সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেন। মন্ত্রমুগ্ধের মত শ্রোতারা তার বক্তব্য শোনেন। প্রচলিত ধারার বাইরে তার বক্তব্য নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে।
শেখ পরশ ভীষণ পরিশ্রমী একজন মানুষ। যুবলীগের সব সাংগঠনিক কার্যক্রম সময়কে ভাগ করে দেখভাল করেন। যার কারণে সংগঠন আজ গতিশীল ও প্রাণবন্ত।
আরেকটি বড় সফলতা শেখ পরশের। তা হলো রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ। সংগঠনে যার যে দায়িত্ব সেই দায়িত্ব তাকেই পালন করতে হয়। এই অনুশীলন তিনি তার সংগঠনে করাতে সক্ষম হয়েছেন। এই কারণে সংগঠনে কোনও বলয় সৃষ্টি হয়নি। ব্যক্তিনির্ভর রাজনীতি পছন্দ করেন না তিনি। যুবলীগ চলছে তার নিজস্ব ভাবধারায়।
যুবলীগকে যেমন তিনি নিজস্ব ভাবধারার উপর চলতে দিয়েছেন। তেমনি নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিত্তির উপরও চলছে যুবলীগ। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের চাঁদার টাকা দিয়ে এবং যুবলীগ প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থগুলো বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে যুবলীগ পরিচালিত হচ্ছে। এটাও শেখ পরশের বড় ধরনের একটা সফলতা।
জেলা কাউন্সিল করছেন নিয়মিত। সব মত ও পথের উর্ধ্বে উঠে ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতাকর্মীদের সংগঠনে জায়গা দিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্ব থেকে তাকে কেউ টলাতে পারেনি।
যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস্ পরশ একটি কথাই সবসময় নেতাকর্মীদের বলে থাকেন,‘৭৫’র ১৫ আগস্ট আপনাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণিকে আঘাত না করে যেমন বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করতে পারেনি। তেমনি আমরা বেঁচে থাকতে আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাকেও কেউ আঘাত করতে পারবে না।
যুব ও তরুণ সমাজ একটি রাষ্ট্রের মূল শক্তি। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধ ফেরত সেই সব যুবসমাজকে সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মণি আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই ধারাবাহিকতায় ‘৭৫-পরবর্তী দুঃসময় অতিক্রম করে গণতন্ত্র রক্ষায় যুবলীগ সবসময় শেখ হাসিনার নির্দেশে অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। সেই যুবলীগ আজ পরিপূর্ণ ও শুদ্ধ যুবলীগ। সেই যুবলীগের শুদ্ধ পুরুষ শেখ ফজলে শামস্ পরশ।
শেখ পরশ একজন সজ্জন ও পণ্ডিত ব্যক্তি। একজন জননন্দিত নেতার ব্যক্তি চরিত্রে যেসব মানবিক গুণাবলী থাকার কথা তার সবকিছু বিদ্যমান। মাত্র ৬ বছর বয়সে মা-বাবাকে হারিয়ে পরতে পরতে বাধার সম্মুখীন হয়ে নিজেকে যোগ্যতম স্থানে অধিষ্ঠিত করে একজন বর্ণিল ও ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যার কণ্ঠে আছে ইন্দ্রজাল, সেই ঐন্দ্রজালিক শক্তিতেই তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যান হয়ে লাখ লাখ যুবককে নিয়ে এসেছেন এক কাতারে।
লেখক: এ্যাড. শেখ নবীরুজ্জামান বাবু একজন গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
বর্তমানে তিনি আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা বিষয়ক উপ সম্পাদক পদে রয়েছেন। এছাড়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ঢাকাস্থ বাগেরহাট জেলা সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন।