আওয়ামী লীগে কাকতাড়ুয়া কই?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

নভেম্বর ৩০, ২০২১, ০৫:৩০ পিএম

আওয়ামী লীগে কাকতাড়ুয়া কই?

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পথচলার সাত দশক চলছে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় দলটি এখন টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়ও। নানামুখী চড়াই-উৎরাই পেরোনো দলটি দীর্ঘ পথচলায় হোঁচট খেলেও কখনো থেমে যায়নি। এই পথচলায় দলটি বারবার অদম্যতার প্রমাণ দিয়েছে। এ দেশে রাজনৈতিক একটি সংস্কৃতি হল, দল ক্ষমতায় গেলে দলের সবার বড় সুসময় আসে; বিরোধী পক্ষে গেলে বড় দুঃসময় হয়। সে হিসেবে আওয়ামী লীগে এখন বড় সুসময় চলছে। 

দেশের ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলটি টানা মেয়াদে এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। ক্ষমতা মানেই সুদিন, আর টানা ক্ষমতা মানে আরও আরও সুদিন। আর সুদিন মানেই ক্ষমতাসীন দলে শুভাকাঙ্খীদের ভিড়। আওয়ামী লীগের নৌকাতেও এখন শুভাকাঙ্খীদের ভিড়ে নড়াচড়া করার জো নেই। দলে নেতাকর্মীর সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছে। ফলে নৌকাতেও গা ঠাঁসাঠাঁসি করা এক অবস্থা। নেতাকর্মীদের গায়ের সাথে গা যেন লেপ্টে যাচ্ছে এখন। যারা পুরানা, ত্যাগী; তারা অনেকটাই নৌকার গুলুইয়ের দিকে কোনঠাঁসা অবস্থায় কোনও রকমে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের বসবারও জো নেই! তাদের অবস্থা অনেকটাই ত্রাহি মধুসূদন। যারা নতুন কিংবা লোকদেখানো শুভাকাঙ্খি, তাদের অবস্থানটা নৌকার ভাল ভাল সব জায়গায়। চলমান ইউপি নির্বাচনকে সামনে রেখে এই ঠাঁসাঠাঁসি অবস্থা আবারও দেখা গেল। এখন সবাই আওয়ামী লীগার। সবাই মনোনয়ন চায়। দেশবাসী এত আওয়ামী লীগার আগে দেখেনি! 

২০০৯ সালে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংসদ নির্বাচনে ‘ভূমিধস বিজয়ের’ মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ৯৬-এর পর দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে। বিপুল বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম ব্যবহার করে ভুঁইফোড় সংগঠনও গড়ে ওঠতে থাকে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ সংগঠনগুলোকে ‘দোকান’ বলা হচ্ছিল তখন থেকেই। এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হয়েও যেতেন! ফলে, সংগঠনগুলোর সংবাদ গণমাধ্যমে আসত। মূলত, গণমাধ্যমে আসার কারণে নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের সভাপতি বা সেক্রেটারি সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিতেন এবং প্রভাব দেখাতেন। এখন এই প্রবণতা মহামারি রুপ নিয়েছে। এই নবাগতরাই ইউপি নির্বাচনে প্রার্থীতা বাগিয়ে নিচ্ছে। তাদের দাপটে পুরানা এবং ত্যাগীরা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। 

এই সুসময়ের আওয়ামী লীগারদের উদ্দেশ্য করেই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক একবার বলেছিলেন, ‘দুঃসময়ে কে আপন কে পর তা চেনা যায়। এখন সুসময়, তাই কাক ও কোকিল চেনা বড় দুষ্কর।’ অর্থাৎ তিনি দলে কাকদের যে বাড়-বাড়ন্ত সেটি কবুল করে নিয়েছেন। অবশ্য একথা দলের শীর্ষ নেতারাও জানেন। নানা সভা-সমাবেশেও তারা এই ‘কাক’দের কথা উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না সেভাবে। ফলে গণতান্ত্রিক একটি দেশে দিনদিন দেশের সব মানুষই এক দলে যোগদান করছে!  আওয়ামী লীগে এখন ভীড় আর ভীড়!

ভিড়টা এতো বেশি যে, সুবিশাল নৌকায় এখন ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ অবস্থা। ফলে নবাগত যাত্রীদের নানাবিধ অপকর্মে মাঝেসাঝেই ডুবোডুবো হয়ে যায় নৌকা। তখনই নৌকার মাঝিমাল্লারা দু-একবার সতর্কতার হাঁক ছাড়েন। এই যেমন একবার দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘প্রচার লীগ, তরুণ লীগ, কর্মজীবী লীগ, ডিজিটাল লীগ, হাইব্রিড লীগ আছে। কথা হাছা, সংগঠনে কাউয়া ঢুকছে। জায়গায় জায়গায় কাউয়া আছে। পেশাহীন পেশিজীবী দরকার নেই। ঘরের ভেতর ঘর বানানো চলবে না। মশারির ভেতর মশারি টানানো চলবে না।’

বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতু যেভাবে বদলায়, আমাদের রাজনীতির মৌসুমও সেভাবে বদলায়। দল ক্ষমতায় আসে, সুদিনের আবহাওয়ায় মৌসুমী অতিথি পাখিরাও ভিড় করে। ক্ষমতা চলে যায়, অতিথি পাখিরাও উড়ে চলে যায় সুবিধাজনক দেশে। শুধু থেকে যায় দেশজ পাখিরা। 

আওয়ামী লীগের নৌকায়ও এখন সর্বকালের আনন্দ কলরব কল্লোল চলছে। এ কলরব সারাবেলা, সারাবছর জুরেই চলছে। ওবায়দুল কাদের সেদিকেই ইঙ্গিত করেছেন। তিনি কাঠখোট্টা ভাষায় এই অতিথিদের ''কাউয়া'' বলে না'ও ডাকতে পারতেন। এতো পাখি থাকতে কেন কাউয়া! কাক'ও নয়! একেবারে তাচ্ছিল্যের সুরে কাউয়া! এমনিতে কাক নিয়েই নানা ওজর আপত্তি আছে কবি-সাহিত্যিকদের। সেখানে কাউয়া ত আরও বড় বেশি বেদনার ডাক।

যাই হোক, কাউয়া ডেকেছেন ঠিক আছে। কিন্তু তিনি কাউয়া তাড়ানোর উপায় বা কাকতাড়ুয়ার সন্ধান দেননি। কারা কাউয়াদের আশ্রয় দেয়, সেটাও বলেননি। অথচ দলে কাউয়া বা কাক আছে, এ সত্য সবারই জানা। কিন্তু কাউয়া কীভাবে তাড়াতে হবে, সেই কাকতাড়ুয়ার সন্ধ্যান দেওয়াই এখন বেশি জরুরি। নাহলে কাউয়ারা সাফল্যের সব ফসল খেয়ে নেবে একে একে। তখন দোষ দেবেন কাকে? 

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট

Link copied!