পৃথিবীর ইতিহাসে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী অন্যতম সেরা ছাত্র আন্দোলন হয়েছে বাংলাদেশে। পাকিস্তান আমলে ছাত্ররা আন্দোলন করে বিশ্বের অন্যতম কঠোর সামরিক শাসকদের মসনদ সরিয়ে দিয়েছে। এরপর যখন তারা অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করেছে তখনো ছাত্ররা বুক চিতিয়ে যুদ্ধ করে প্রশিক্ষিত বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছে। ছাত্রদের ‘মানি না মানবো না’ স্লোগান ধীরে ধীরে পৃথিবীর বুকে একটি রাষ্ট্রই তৈরি করে ফেলেছে।
এমন ইতিহাস কয়টি দেশের আছে? বাংলাদেশে সৃষ্টির পরও যখন পাকিস্তানি কায়দায় দেশ শাসনের অপচেষ্টা চলে তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রাণ বিসর্জনে স্বাধীনতা দিয়ে যাওয়া ছাত্র-জনতার উত্তরসূরী হিসেবে আমরাও সেই স্বৈরশাসকদের রুখে দিয়েছি। তেমনি একটি দিন আজ।
১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল। তার পদত্যাগের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন এবং জাতীয় সংসদ বাতিল হয়।
বাংলাদেশ বর্তমানে একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আছে। একদিকে রোহিঙ্গা সমস্যা, সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, দেশে আইনের শাসনের অভাব, দেশের টাকা পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশকে কাক্সিক্ষত অর্থনীতির সমৃদ্ধির দিকে আইনের শাসন এবং মানবিক বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে অচল অবস্থা বিরাজ করছে।
এ অবস্থায় আমাদের নব্বইয়ের যে আকাক্সক্ষা তা পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। সেটা অর্জন করতে হলে গণতান্ত্রিক দল, নেতা-কর্মীদের সোচ্চার থাকতে হবে। মানুষের সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক মানবাধিকার ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
রাষ্ট্রের বহুমুখী সমস্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ হতে এখন আর মূল ধারার ছাত্র সংগঠনগুগলোকে দেখা যায় না। বিজয়ের এই মাসেও রাজধানীর রাজপথে ছাত্র আন্দোলন চলছে। এই ছাত্র আন্দোলন চলছে কিশোরদের নেতৃত্বে। রাষ্ট্রের অন্যতম বড় একটি সমস্যা সড়ক ‘হত্যা’র মতো ইস্যুতে কিশোর ছাত্রদের মাঠে নেমে আসতে হচ্ছে। আমাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর জাতীয় সমস্যা নিয়ে কথা বলে না, আন্দোলন তো দূরের কথা। এর চেয়েও বড় পরিতাপ লাগে যখন গণমাধ্যমে দেখি, কিশোরদের আন্দোলন দমানোর জন্যই সরকারি সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের নামে কিছু যুবক কিশোরদের ধাওয়া করে। এ কোন বাংলাদেশ!
নব্বইয়ে আমরা যে চেতনা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলাম, গত ৩০ বছরে সামাজিক সূচকেও দেশ অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। এখন জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম বেগবান করতে হবে ১৯৭১ ও ১৯৯০-এর চেতনায়। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ যখন তৎকালীন সেনাপ্রধান লে. জে. হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। সে সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার। সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেই সামরিক আইন জারি করেন।
সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে ছাত্ররা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা অঘটন-ঘটনের নায়ক ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসব ক্ষত ও দুর্বল স্থান আছে, সবগুলোই সৃষ্টি করে গেছেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ও এরশাদ। আর এর জন্য সমাজকে মূল্য দিতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে।
১৯৮২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে মজিদ খানের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি বাতিলের বিরোধিতা করে ছাত্র সংগঠনগুলো। ওই বছরের নভেম্বরে সব ছাত্র সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ ফোরাম ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তের বন্যা বয়ে যায়। ক্যাম্পাসে ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নামলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, জাফর ও দীপালি সাহা। এ রক্তের ধারা গড়ায় অনেক দূর। মিশে যায় রাউফুন বসুনিয়া, রমিজ, তিতাস, মুনীর, জুয়েল, ডা. মিলনের রক্তে।
১৯৮৭ সালে মিছিলে পুলিশের গুলিতে নূর হোসেন নিহত হওয়ার ঘটনা আন্দোলনে গতি এনে দেয়। ক্ষমতার শেষের দিকে আবারও সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠেন এরশাদ। কিন্তু গণ-আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। স্বৈরাচার এরশাদকে হটিয়ে আমরা দেশে গণতন্ত্র এনেছি।
গত কয়েক মেয়াদে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর দেশের দারিদ্র্যবিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণ, শিক্ষার হার ও গড়আয়ু বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদেরই শুধু নয়, অনেক উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ।
কিন্তু এই জায়গাতেই তৃপ্ত হয়ে থাকলে হবে না, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা যেমন কঠিন, তেমনি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার সঙ্গে বহু সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষাতেও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।