করোনা মহামারির ভীতি এখন অনেকটাই কেটে গেছে। অথচ গত দুই বছর করোনা ছিল রীতিমত ভীতি জাগানিয়া। লাখো মানুষের মৃত্যু হয়েছে এই মহামারিতে। ভয়াবহ এই বিশ্বদুর্যোগে ইউরোপ-আমেরিকাসহ গোটা দুনিয়ার বাঘা বাঘা দেশ যেখানে নাকানি চুবানি খেয়েছে এবং খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো অপেক্ষাকৃত অস্বচ্ছল দেশ পরিস্থিতি দারুনভাবে সামলে নিয়েছে। শুধু পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে বললে কমই বলা হয়। বাংলাদেশ মহামারি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সারাদেশে করোনার গণটিকাদানের কর্মসূচি সফল করেছে, সেটিও বহির্বিশ্বের নজর কেড়েছে। উপরন্তু পরিকল্পিত লকডাউন, আবার সেটি তুলে দিয়ে কড়া বিধিনিষেধ বজায় রেখে সীমিত পরিসরে দোকানপাট চালু, এরপর বৃহত্তর পরিসরে সকল বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড চালুর মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাও সচল রেখেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের এমন সাফল্য বিশ্বকে বিস্মিত করেছে। এটা মানতেই হবে যে, মহামারি জেঁকে বসার আগেভাগেই এসব সিদ্ধান্ত না নিলে একদিকে বেশি প্রাণহানি এবং অন্যদিকে আর্থিক বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়তে হতো আমাদের। সেটা অন্তত হয়নি।
সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে। তিনি হয়ত আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, কয়েক মাসেই করোনা পরিস্থিতির সমাধান মিলবে না। সামনের দিনগুলোতে এই মহামারির কুফল কেমন হতে পারে, তিনি হয়ত সেটি নিয়েও ভেবেছিলেন।
দুই বছর আগের মার্চে করোনাভাইরাস যখন এ দেশে প্রথম সনাক্ত হয়, জনমনে নিদারুন আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল তখন। সে সময় মানুষের আতঙ্ক কাটানোর জন্য এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক কিছু কৌশল নিয়েছিল সরকার যা তাদেরকে ত্বরিৎ সাফল্য এনে দিয়েছে।
এরমধ্যে বড় যে পদক্ষেপটি ছিল, সেটি হল তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে কয়েক হাজার নার্স ও ডাক্তার নিয়োগ প্রদান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করোনা মোকাবিলায় মাত্র ১৫ দিনে ২০০০ ডাক্তার ও ৫০০০ হাজার নার্স তখন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা জানি, এ দেশে এরকম একটি নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে এক বছরেরও বেশি সময় লেগে যায়। কিন্তু আলোচিত ওই নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্ভব হয়েছিল বাংলাদেশের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার কারণে।
এরপরই সরকার করোনার টিকা কিনে রাখার সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। মহামারি ছড়িূয়ে পড়ার পর গোটা বিশ্বে কী হবে, সেটিই বোধ করি অনুমান করতে পেরেছিলেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনা। এ কারণেই কয়েক কোটি টিকা কিনে রাখার সিদ্ধান্ত তিনি নিয়ে রেখেছিলেন আগেভাগেই। এ জন্য বাজেট থেকে বড় অঙ্কের একটি অর্থও তিনি টিকা কেনার জন্য আলাদা করে রেখেছিলেন। তখন এমন সিদ্ধান্তে অনেকের মনে দ্বিধা কাজ করলেও, পরে সবাই তার এমন সিদ্ধান্তের প্রশংসা করছেন। এমনকি বিশ্বনেতারাও শেখ হাসিনার করোনার বিরুদ্ধে এমন লড়াইয়ের ভূমিকার প্রশংসা করছেন।
সরকার শুধু রাজধানী নয়, প্রতিটি উপজেলার হাসপাতালগুলোকে করোনা চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছে। এসব হাসপাতাল এখন করোনাভাইরাসের টিকা প্রদানের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমন দুর্যোগে চিকিৎসা এবং টিকা প্রদানই শুধু নয়, সরকার তাঁর নিজ দল আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের দিয়ে কোটি পরিবারে ত্রাণ সহায়তাও পৌঁছে দিয়েছে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে করোনা মোকাবিলায় যেমনটা ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি তাঁর দল আওয়ামী লীগকেও তিনি সমানতালে ব্যবহার করেছেন। দলের নেতাকর্মীরা মানুষের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তাঁদের অনেকে করোনা সংক্রমিত হয়ে মারাও গেছেন। আওয়ামী লীগের বিশেষ করে সহযোগী সংগঠনগুলোর এই আত্মবলিদানকে আপামর জনগণ ভালভাবে নিয়েছে।
এদিকে লকডাউনের শুরু থেকেই মানুষকে ঘরমুখী করতে প্রশাসন মাঠ পর্যায়ে কাজ করা শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রী বিচক্ষণতার সাথে কোন্ কাজটি কখন করতে হবে, বিশ্বে কভোড পরিস্থিতিতে কোথায় কী হচ্ছে— সব কিছু স্টাডি করে তিনি বারবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নির্দেশনা দিয়েছেন, অনলাইন মাধ্যমের সুবাদে এসব কর্মকাণ্ড আমরা দেখেছি তখন। যারফলে জেলা-উপজেলার মানুষকে সচেতন করতে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা এগিয়ে এসেছেন। মহামারিতে মারা যাওয়া লোকজনের দাফন-সৎকার থেকে শুরু করে ত্রাণ কার্যক্রমে নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা করে গেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁরা সাধারণ ছুটির মধ্যেও আন্তরিকতার সাথে একেবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ত্রাণ থেকে শুরু করে সব ধরণেরর কর্মকাণ্ড করেছেন। করোনার মৃত্যুভয় মোকাবিলা করে প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এমন সাহসী ভূমিকা বহুদিন মনে রাখবে মানুষ।
করোনাকালে বাংলাদেশ সরকার তথা সরকার প্রধান শেখ হাসিনা, তাঁর দলের কর্মীদের আত্মত্যাগের কথা এবং প্রশাসনের এমন তৎপরতার কথা, দূরদর্শী কর্মকাণ্ডের কথা সেভাবে পত্রপত্রিকায় আসেনি। এর কারণ হতে পারে, হয়ত মিডিয়া সব সময় নেতিবাচক খবর বেশি করে প্রচারে আগ্রহী। এটি অবশ্য আগের প্রবণতা ছিল যে, যত বড় নেতিবাচকতা, তত বড় সংবাদ। অর্থাৎ খুব খারাপ সংবাদ মানেই ভাল সংবাদ। কিন্তু এখন প্রবণতা বদলে গেছে। ইতিবাচকতা পাঠকরা ভালভাবে নিচ্ছেন। আমরা দেখি, বেশিরভাগ ইতিবাচক সংবাদই এখন ভাইরাল হচ্ছে। এই প্রবণতা আমাদের আশাবাদী করে।
আমরা যেন ভাল কাজের প্রশংসা করি, মন্দ কাজের সমালোচনাটাও করি। এটিই সাংবাদিকতা। এটিকেই বলে সমানভাবে আলোচনা—সমালোচনা। সরকারের কাজের সমালোচনা করার মত অনেক বিষয়ই আছে। প্রশংসা করার মতও তাদের অনেক বিষয় আছে। বোধ করি করোনা মহামারীতে সরকার যেসব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তাতে প্রশংসার পাল্লাই ভারী। যে কারণে বিশ্বের অনেক দেশই বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে রোল মডেল হিসেবে মনে করেছে। তবে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির লাগাম যদি টেনে রাখা যেত, তাহলে আরও ভাল করত বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ শুধু করোনা মহামারি নয়, ভবিষ্যতের শত বাধার পাহাড়ও এভাবে অবলীলায় ডিঙিয়ে জয়ী হবে, এমন আশাবাদ আমাদের।
লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট