কেন ডলারকে হঠানো সম্ভব নয়?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

মে ৫, ২০২৩, ০৮:৫৮ পিএম

কেন ডলারকে হঠানো সম্ভব নয়?

সম্প্রতি বিশ্বজুড়ে একটি নতুন বলয় সৃষ্টি করা হচ্ছে। যেখানে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ডলারের বিকল্প একটি কারেন্সি প্রস্তুত করতে কয়েকটি দেশ চেষ্টা করছে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে আদৌ কি ডলারের বিকল্প কারেন্সি প্রস্তুত করা সম্ভব। আর ঠিক কি কারণে ডলার এত শক্তিশালী।

ডলারের বিকল্পের প্রথম আঘাত আসে রাশিয়া থেকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার ওপর স্যাংশন আসলে রাশিয়া জার্মানিকে তাদের তেলের দাম রুবলে পরিশোধ করতে বলে। এদিকে চীন তাদের মুদ্রা ইউয়ানে বিনিময় করার জন্য ব্রাজিলের সাথে একটি চুক্তিও করে। এদিকে বাংলাদেশও কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের অর্থ রাশিয়াকে পরিশোধ করে চীনের ইউয়ানে। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে আসলেই কি ইউয়ান হতে যাচ্ছে নতুন রিজার্ভের মুদ্রা।

উত্তরটা জটিল। তবে আগে জেনে আসি কেন ডলার এত শক্তিশালী। ১৯১৪ সালে বিশ্বযুদ্ধের ফান্ডিংয়ের জন্য যুক্তরাজ্য বা গ্রেট ব্রিটেনের প্রচুর অর্থ দরকার হয়। তাই তারা পাউন্ডের সাথে স্বর্ণের ভিত্তি ছিন্ন করে। তবে এই সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের রসদ সরবারহ করে স্বর্ণের বিনিময়ে। ১৯৪৪ সাথে বিশ্বের তিনভাগে দুইভাগ স্বর্ণ তখন যুক্তরাষ্ট্রের দখলে চলে যায়।

এ সময় স্বর্ণের ভিত্তিতে ডলারের দাম নির্ধারিত হচ্ছিল। ১৯৪৪ সালেই ব্রেটেন উডস কনফারেন্সের মাধ্যমে ৪৪টি দেশ স্থায়ী মুদ্রা হিসেবে ডলারকে বেছে নেয়। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের অধীনেই বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ ছিল। তাই অন্য মুদ্রা স্বর্ণের বিপরীতে খুবই দুর্বল। আর সবচেয়ে বড় অর্থনীতিও ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। যার ফলে একবাক্যে সবাই ডলারকে তাদের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মেনে নেয়।

এদিকে ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্বর্ণের সাথে ডলারের সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়। কেননা ভিয়েতনামের সাথে যুদ্ধে তাদের প্রচুর অর্থ দরকার। আর ডলার রেট তখন বাড়াতেও পারছিল না। তাই এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা যত খুশি ডলার ছাপাতে পারবে।

এর আগে কিন্তু একটা বড় একটি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৯৭০ সালে। যেটা অয়েলডলার কারেন্সী নামে পরিচিত। যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তেল কিনতে হলে সেটি ডলারের মাধ্যমে কিনতে হবে। যার ফলে বর্তমানে ৮০ শতাংশ তেলের লেনদেন ডলারের মাধ্যমে হয়।

কিন্তু এতদিনেও কেন ডলার স্থায়ী মুদ্রা হয়। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।

প্রথমেই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা।

বর্তমানে সবচেয়ে বড় জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রের। যা প্রায় ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার। চীনের ১৮ ট্রিলিয়ন ডলার। বিশ্বের ৯০ শতাংশ ফরেন এক্সচেঞ্জ হচ্ছে ডলারের মাধ্যমে। এমনকি ২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাতেও কিন্তু ইউএস ডলার স্থিতিশীল অবস্থায় ছিল।

দ্বিতীয় হচ্ছে রাজনৈতিক।

রাজনৈতিক ক্ষমতাও রিজার্ভ কারেন্সির স্থিতির জন্য দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের মত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ খুব কম দেশই করে। রাজনৈতিক দিক থেকে রাশিয়াও অনেকটা প্রভাব রাখতে শুরু করেছে। কিন্তু চীন ও ভারতের অর্থনীতি শক্তিশালী হলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে তারা অনেকটাই পিছিয়ে।

আর তৃতীয় হচ্ছে সামরিক।

ন্যাটো বলুন কিংবা বহর পাঠানো সব কিছুতেই কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে। বর্তমান বিশ্বে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর প্রবণতা কম থাকলেও সামরিক শক্তি প্রদর্শনে যুক্তরাষ্ট্র যে এগিয়ে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবে এখন আসি কেন ডলারের দ্বিতীয় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়নি। আর কি কারণে চীনের ইউয়ান ও রাশিয়ার রুবল এখনও অনেক দুর্বল অবস্থানে রয়েছে।

চীন ও রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থানের কথা যদি বিবেচনা করেন তাহলে আসে একটি জোটের কথা। যেটি হলো ব্রিকস। ব্রিকসের প্রধান রাশিয়া। এছাড়া চীন, ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা রয়েছে এই জোটে। এই জোটের মধ্যেই মুদ্রা নিয়ে রয়েছে দ্বন্দ। রাশিয়া রুবলকে শক্তিশালী করতে যাচ্ছে, চীন আগে থেকেই ইউয়ানকে সংগঠিত করছে। এরই মধ্যে ভারত কিন্তু রূপির রিজার্ভ বাড়াতে চেষ্টা করছে। যার ফলে ব্রিকসের অধীনে কোন মুদ্রা রিজার্ভ মুদ্রা হয়ে উঠবে তা কিন্তু নিজেরাই নির্ধারণ করতে পারেনি।

এদিকে রাজনৈতিক জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে। সমাজতান্ত্রিক দেশ হলেও মুক্ত গণমাধ্যমে অনেক পিছিয়ে রয়েছে চীন ও রাশিয়া। যার ফলে সরকার ঠিক কি কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এই সম্পর্কে অবগত হতে পারছে না অন্যান্য দেশ। যেটি অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করতে পারে। যে কারনে একান্ত বাধ্য না হলে কিন্তু নতুন কারেন্সিতে কেউ ঝুঁকছে না।

কপিরাইট, প্যাটেন্ট নতুন বিনিয়োগ সুরক্ষা না থাকা

যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু কোন আবিষ্কার কিংবা বিনিয়োগ অত্যন্ত সুরক্ষিত। কেননা সেখানে প্যাটেন্ট পদ্ধতি থাকে। কেউ যদি নতুন কিছু আবিষ্কার করে থাকে তাহলে সে প্যাটেন্টের মাধ্যমে তার মেধাস্বত্ব রক্ষা করতে পারে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে ছোট প্রতিষ্ঠানও প্রতিযোগিতা করে আসছে। কিন্তু চীনে প্যাটেন্ট ও কপিরাইটের অবস্থা নড়বড়ে। যে কারনে কারও আবিষ্কার নকল বা চুরি হলে তা দাবি করতে পারা যায় না। এ কারণেই সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা স্থায়ী হয়নি।

অর্থাৎ উৎপাদন ও শিল্প কারখানার জন্যই চীন সুরক্ষিত। নতুন আবিষ্কারের জন্য না।

এদিকে ডলারের বদলে চীন ইউয়ানে বিনিময় করতে চায় তাহলে চীনেরও অসুবিধা হবে। বর্তমানে যদি নিজস্ব মুদ্রায় বিনিময় করতে যায় তাহলে কি কি সমস্যা হতে পারে।

প্রথমেই আসি রিজার্ভ। চীনের রিজার্ভে এখন ৩ হাজার ১৮৩ বিলিয়ন ডলার রয়েছে। অর্থাৎ চীন নিজেই ডলারের বড় উৎস। এই ডলারের বদলে যদি ইউয়ান গ্রহণ করতে যায় তাহলে ইউয়ানের বিনিময় হার বৃদ্ধি পাবে। আর ইউয়ানের মান বৃদ্ধি পেলে বড় আঘাত আসবে চীনে উৎপাদিত পণ্যমূল্যে। যেখানে চীনের রপ্তানি পণ্যেই দাম অন্তত ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।  

আরেকটি সমস্যা হচ্ছে চীনের জন্মসংখ্যা কমে যাচ্ছে। যে কারনে চীনের শ্রমিক ও উৎপাদন যে কমে যাচ্ছে সেটি বড় একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।

ডলারের রাজত্ব যে সহসাই যাচ্ছে না তা বিভিন্ন সূচকেই বুঝা যাচ্ছে। তবে বিভিন্ন দেশকে স্যাংশন দেয়ার পাশাপাশি বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির ফলে ডলার মান বৃদ্ধিতে অনেকেই বিকল্প ভাবছে। তবে বিভিন্ন সূচকে ডলারকে হঠানো অসম্ভব একটি প্রক্রিয়া হয়ে দাড়িয়েছে।

Link copied!