তুরস্ক-রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও পশ্চিমাবিশ্ব

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জানুয়ারি ২৮, ২০২৩, ১০:৩৪ এএম

তুরস্ক-রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও পশ্চিমাবিশ্ব

বিশ্ব রাজনীতির দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে চলেছে- রাশিয়া এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নিশ্চয়ই এই দুই নির্বাচন অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটাবে বলে বিশ্লেষকদের অভিমত।

রুশ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

কোভিড-১৯ মহামারির ধকল থেকে বিশ্ব ঘুরে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই শুরু হয় রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। রাজনৈতিক মানচিত্রে এ যুদ্ধ রাশিয়া-ইউক্রেনে সীমাবদ্ধ থাকলেও অর্থনৈতিক মানচিত্রে তা সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়ার বিরুদ্ধে সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়াও কিছু পালটা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কারণে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতিও চাপে পড়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো আরো চাপে আছে। যু্দ্ধ মানে ধ্বংস। যুদ্ধে কাউকে পরাজিত করতে গেলে নিজের পরাজয়ও কম হয় না।

এই পরিস্থিতিতে সামনে আসছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ২০২৩ সাল রাশিয়ার জন্য নাটকীয় বছর। রাশিয়ার বর্তমান নেতৃত্ব টিকে থাকবে কিনা, তা নির্ধারিত হতে পারে এ বছরই। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে দুটি অভ্যন্তরীণ প্রশ্নের ওপর, যা দেশটির বর্তমান তো বটেই আগামী কয়েক দশকেরও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দিতে পারে।

প্রথমত, ২০২৩ সালেই পুতিনকে নির্ধারণ করতে হবে যে, তিনি ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, নাকি নিজের উত্তরসূরি ঘোষণা করবেন। দেশটির ২০২০ সালের সংশোধিত সংবিধান অনুসারে, ২০৩৬ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারবেন পুতিন। তারপরও নির্বাচনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য পুতিনের হাতে এখনো পর্যাপ্ত সময় রয়েছে। রাশিয়ায় পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে ২০২৪ সালের মার্চে। ফলে পুতিন চাইলে চলতি বছরের শেষ দিকেও তাঁর সিদ্ধান্ত জানাতে পারবেন। 

তবে এ বিষয়ে পুতিনের পরিকল্পনা কী, সে বিষয়ে কেউ জানে না। এমনকি তাঁর প্রিয়ভাজন এলিটরাও রয়েছেন অন্ধকারে। ২০২০ সালের গ্রীষ্মে পুতিন তাঁর ক্ষমতার মেয়াদ আরও দীর্ঘায়িত করার জন্য সংবিধান সংশোধন করেন। সে সময় তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে থাকা দেশটির এলিট শ্রেণির দ্বন্দ্বকে সংবিধান সংশোধনের কারণ উল্লেখ করে সেটিকে ন্যায্যতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের কাজ করতে হবে, কে কার উত্তরসূরি হবে সে বিষয় ভেবে সময়ক্ষেপণ করা চলবে না।’  

সংবিধান সংশোধনের পর দেশটির প্রশাসন ও এলিট শ্রেণি নিশ্চিতভাবেই অনুমান করে নেয়, পুতিনের ইচ্ছা অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতা ধরে রাখা। তবে বাস্তবতা হলো, তাঁর সেদিনের হিসাব বদলে গেছে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এ যুদ্ধে কোনো কিছুই আর পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটছে না। 

দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলো রাশিয়ার দুই শ্রেণির এলিটদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে। এক পক্ষ যুদ্ধের পক্ষে ওকালতকারী গোষ্ঠী; অন্যদিকে রয়েছে, যারা যুদ্ধ না করার পক্ষপাতী। ইউক্রেনের খারকিভ থেকে রুশ সেনাদের পশ্চাদপসারণের পর এ বিভেদ আরও স্পষ্ট হয়। ক্রিমিয়া সেতুতে বিস্ফোরণ সেই বিভেদের আগুনে আরও উসকানি দেয়। একই সঙ্গে রাশিয়ার দখলকৃত ইউক্রেনের চার অঞ্চলকে গণভোটের মাধ্যমে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার বিষয়টিও এ বিভেদের আগুনে ঘি ঢেলেছে।

রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ ১১ মাস অতিক্রম করে এগারো মাসে পদার্পণ করেছে। যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। অনেকে বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ ইউক্রেনের হাতে নেই। আমেরিকা ইউক্রেনকে যুদ্ধের অস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ ও গোয়েন্দা তথ্য—সবকিছু দিয়ে সাহায্য করছে। এই যুদ্ধে ইউক্রেন, রাশিয়া এমনকি ইউরোপ ধ্বংস হলে কার কী যায় আসে? এজন্য ইউরোপ নিজের অস্তিত্বের স্বার্থেই এই যুদ্ধে ইউক্রেনকে সাহায্য করছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন এ যুদ্ধকে গিলতে পারছেন না, আবার ওগরাতেও পারছেন না।

আরেকটি বিষয় এখানে বলে রাখা দরকার, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে প্রশাসনে অনেক বড় রদবদল হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কারণ নির্বাচনের আগে প্রশাসনিক পদে রদবদল হয়নি এমনটা রাশিয়ার নির্বাচনী ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। এক্ষেত্রে নানা কারণেই টেকনোক্র্যাটদের প্রশাসনের শীর্ষ পদে আনার প্রবণতা বাড়তে পারে পুতিনের। মন্ত্রিসভায়ও যদি দু-চারজন টেকনোক্র্যাট ঢুকে পড়েন, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। যুদ্ধ এবং দীর্ঘ সময়ের চাকরি জীবনের কারণে অনেকেই ক্লান্ত। এ অবস্থায় পুতিন নতুন আইডিয়ার জন্য টেকনোক্র্যাটদের দ্বারস্থ হতে পারেন।

তুরস্কের নির্বাচন

তুরস্কে আগামী ১৪ মে পার্লামেন্ট ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এ ঘোষণা দিয়েছেন।

এই নির্বাচন একদিকে যেমন প্রাজ্ঞ-প্রবীণ রাজনীতিক এরদোয়ানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, অন্যদিকে বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ এবং এমনকি ন্যাটোর ভবিষ্যৎ অবস্থান ও কার্যক্রমকেও প্রভাবিত করবে বলে বিশ্ব গণমাধ্যমের সংবাদ বিশ্লেষকদের অভিমত।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট পদে ২০ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করে আসছেন এরদোগান। এই দুই দশকের মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছেন ৬৮ বছর বয়সি এই নেতা।

মূল্যস্ফীতি আর খাদ্যপণ্যের দামবৃদ্ধির কারণে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে এরদোগানকে। এবারের নির্বাচনে মূল্যস্ফীতি সামলাতে না পারার খেসারত দিতে হতে পারে একে পার্টির এই নেতাকে।

এরদোগানের আমলেই মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় তুরস্ক। তবে সম্প্রতি অর্থনৈতিক কিছু ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যাপকভাবে অর্থের মান কমেছে দেশটিতে। 

এরদোয়ানের দুই দশকের ক্ষমতায় প্রথম দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থাকলেও গত ১০ বছরে তা হ্রাস পেয়েছে। যা ভোটারদের কাছে তার জনপ্রিয়তাকে কমাতে পারে। তারপরেও এরদোয়ানের একে পার্টি এখনো তুরস্কের সবচেয়ে শক্তিশালী দল এবং পার্লামেন্টে প্রভাবশালী হিসেবে টিকে আছে। অবশ্য জনমত জরিপে দেখা গেছে, কয়েকজন সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর তুলনায় পিছিয়ে আছেন এরদোয়ান।

সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টাকে সমর্থন করেছেন এরদোয়ান। তিনি ৩.৬ মিলিয়নেরও বেশি সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন। যা তুরস্কে অর্থনৈতিক সংকটকে প্রকট করেছে।

গত ৯ জানুয়ারি ওয়াশিংটন পোস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হবে তুরস্কে। এই নির্বাচনের ফলের দিকে চোখ থাকবে ওয়াশিংটন, মস্কোর পাশাপাশি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং আফ্রিকার।

রজব তাইয়্যেব এরদোগান নিজেকে একজন ধর্মনিরপেক্ষ দাবী করলেও তাঁর প্রধান সমর্থক হচ্ছেন ইসলামপন্থী ও ধার্মিক বয়স্ক তুর্কিরা। তুরস্কে এতকাল ধরে চলে আসা ইসলাম বিদ্বেষী রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামী মূল্যবোধকে শক্তিশালী করেছেন এরদোগান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, তুরস্কের নির্বাচনে এরদোগান তুরস্কের উপর তাঁর শাসন ব্যবস্থাকে তৃতীয় দশকে প্রসারিত করার চেষ্টা করবেন। আর এই নির্বাচনের ফলাফলটিই ওয়াশিংটন, মস্কো, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকার ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোকেই অঙ্কন করবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী 

Link copied!