দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে আশার আলোর ঝলকানি

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

অক্টোবর ১৭, ২০২২, ০১:১০ পিএম

দেশের চলচ্চিত্র শিল্পে আশার আলোর ঝলকানি

দেশের ঝিমিয়ে পড়া চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে আবারও আশার আলো দেখা যাচ্ছে। চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া— সর্বত্র এখন চিত্রজগত নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। এসব আলাপ-আলোচনার বেশিরভাগই হচ্ছে সাম্প্রতিক কয়েক মাসে মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর জমজমাট ব্যবসা নিয়ে। ছবিগুলোর নির্মাণ শৈলী, সবলতা-দুর্বলতা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। পত্রপত্রিকার পাতা জুড়ে সেসব ছাপাও হচ্ছে।

শিল্প কিন্তু এরকম আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়েই টিকে থাকে, এগিয়ে যায়, শাণিত হয়। ভালো চলচ্চিত্র না হওয়ায় এই চর্চাটা বহুদিন অনুপস্থিত ছিলো আমাদের শোবিজ অঙ্গনে।

তবে মান্দাতা আমলের প্রেক্ষাগৃহে সিনেমা দেখতে রাজি নয় এ যুগের আধুনিক দর্শকেরা। তাঁদের পছন্দ সিনেপ্লেক্স বা নিদেনপক্ষে মিনিপ্লেক্স। এসব আধুনিক রঙ্গালয়েই নতুন মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলো দেখতে ভীড় করছে দর্শকেরা। কেন এই সিনেপ্লেক্সপ্রীতি দর্শকদের? একদিনের একটি উদাহরন দেওয়া যেতে পারে এ ক্ষেত্রে।

ঘটনাটি গত ৫ আগস্ট, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯ টার। নারায়ণগঞ্জ নগরীর গুলশান সিনেমা হলে রাতের প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। দর্শক নেই। উপর ও নিচতলা মিলিয়ে সাত শতাধিক আসনের প্রায়গুলোই ফাঁকা। একই দশা নিউ মেট্রো সিনেমা হলের। আলোচিত চলচ্চিত্র ‘হাওয়া’ দেখতে ৮০০ আসনের হলে টিকেট কেটেছেন মোটে ৫৯ জন!

হাওয়া দেখতে যেখানে নিউ মেট্রোতে দর্শক নেই, সেখানে সদ্য চালু হওয়া প্রেক্ষাগৃহ সিনেস্কোপে সেই একই সিনেমার টিকেটের জন্য চলছিলো হাহাকার। গত এক সপ্তাহে ‘হাওয়া’র ২৮টি শো’র সবগুলোই হাউজফুল সেই মিনিপ্লেক্সে!

এখানেই যাদু সিনেপ্লেক্সের। আধুনিক জোরালো শব্দ, নিখুঁত ছবি, বসার আরামদায়ক ব্যবস্থা, সব মিলিয়ে দারুন এক সিনেমা দেখার অভিজ্ঞতা। যারফলে প্রেক্ষাগৃহ মালিক ও দর্শক দুই পক্ষেরই লাভ। এভাবেই সময়ের প্রয়োজনে বদলে যাচ্ছে সিনেজগতের সংস্কৃতি।

কম খরচের প্রেক্ষাগৃহ ২০-৩০ সিটের মিনিপ্লেক্স একটি দারুণ ধারনা। দিনকে দিন নতুন ধারার এই সিনেমা প্রদর্শণের ব্যবস্থা বিকাশের দারুন সম্ভাবনা জেগেছে এ দেশে।

সিনেমা শিল্পের ধসের কারণে দেশের সাংস্কৃতিক এক শূণ্যতা বিরাজ করছে। গ্রামীণ যাত্রাপালা আর নাটকের বিদায় ঘটেছে সেই কবেই। সব মিলিয়ে দেশে সাংস্কৃতিক এক মহাশূণ্যতা চলছে। তরুণ প্রজন্ম তাঁদের শেকড় ভুলে যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে অপরাধে জড়ানোর হারও বেড়ে গেছে। সেই সাংস্কৃতিক শূণ্যতা কিছুটা হলেও পূরণ হবে সিনেশিল্পের এই ঘুরে দাঁড়ানোয়। এরইমধ্যে দেশের শীর্ষতম একটি সিনেপ্লেক্স কোম্পানি তাঁদের নিজস্ব অর্থায়নে চারটি সিনেমা তৈরির ঘোষণা দিয়েছে। এ রকম উদ্যোগ বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের পালে নতুন হাওয়া বইয়ে দেবে।

বছরের পর বছর বিনিয়োগের অভাবে জরাজীর্ণ অবকাঠামো, সেই সাথে ভালো চলচ্চিত্রের অভাব ছিলো সিনেমা হলে। এই অবস্থার মধ্যেই হানা দেয় করোনাভাইরাস মহামারি। এ যেন দেশের পুরনো সিনেমা হলের কফিনে শেষ পেরেক! এখন প্রায় ‘বিলুপ্তির’ কাছাকাছি গিয়ে ঠেকেছে সিনেমা হলগুলো। করোনা পরবর্তী সময়ে মাল্টিপ্লেক্স ও মিনিপ্লেক্সে বিনিয়োগ লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠছে।

সিনেমা শিল্পের সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, অল্প সিটের মিনিপ্লেক্স থেকে একজন প্রযোজক সিঙ্গেল স্ক্রিনের চেয়েও বেশি শেয়ার মানি পেতে পারেন। গত ঈদুল আযহায় পরাণ, সাইকো এবং দিন: দ্য ডে নামের তিনটি সিনেমা মুক্তি পায়। এ তিনটি সিনেমার প্রতি দর্শকেরা দারুণ সাড়াও দেয়।

এটি ঠিক যে, সবকিছু বদলে যাচ্ছে, বদলে যাবে। কোনো কিছুকে সময়ের বিপরীতে অপরিবর্তনীয় রাখা যায় না। রূপালী পর্দার সিনেমা হলের বিদায় ঘটেছে। সেখানে এসেছে সিনেপ্লেক্স। এসেছে ওটিটি প্লাটফরম। এসেছে মিনি সিনেপ্লেক্স। নতুন প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের বিত্তেরও বদল ঘটেছে। নিম্নবিত্ত নয়, এসব আধুনিক রঙ্গালয়ে সিনেমা দেখতে ছুটছেন মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তরা। টিকেটের উচ্চমূল্যের কারণে নিম্নবিত্তরা হয়তো ওমুখো হচ্ছেন না। হবার কথাও নয়। তাঁরা সিনেমার স্বাদ মেটাচ্ছেন ডিশলাইন কিংবা ইন্টারনেট টিভিতে।

যে যেখানেই সিনেমা দেখেন, তাতে লাভ হচ্ছে বাংলা সিনেমার, বাঙালি সংস্কৃতিরই।

বিশ্ব এখন দ্রুততায় বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে বিনোদন লাভের পদ্ধতিও। তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর কম্পিউটার, মোবাইল ও ইন্টারনেটের ভিড়ে হারিয়ে গেছে রেডিও-টেপ রেকর্ডার। মেমরি কার্ড আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে হারিয়ে গেছে সিডি ও ভিসিডি। হারিয়ে যেতে বসেছে অ্যানালগ টেলিভিশন ও পুরনো সিনেমা হল। এসব পরিবর্তন মেনে না নেওয়ার উপায় নেই।

প্রবণতা যেভাবে দ্রুততায় বদলাচ্ছে, তাতে করে কয়েক বছরের মধ্যে দেশের বড় শহরগুলোয় মাল্টিপ্লেক্সে সয়লাব হয়ে যাবে, এমন ধারনা বিশ্লেষকদের। এরইমধ্যে একটি করে পর্দা ও স্বল্পসংখ্যক আসন নিয়ে নারায়ণগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জে চলছে দুটি মিনি সিনেপ্লেক্স। সিরাজগঞ্জের রুটস সিনেক্লাবের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, তাঁরা সিরাজগঞ্জসহ দেশের অন্যত্র আরও কয়েকটি মিনি সিনেপ্লেক্সের শাখা খুলবেন।

এ দুটি মিনি সিনেপ্লেক্সের কর্তৃপক্ষ তাঁদের ব্যবসা নিয়ে খুবই আশাবাদী। এ ধরনের উদ্যোগ সিনেমা ব্যবসায় নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে। এদের দেখাদেখি যদি সারা দেশের জেলা ও উপজেলায় মিনি সিনেপ্লেক্স তৈরি হয়, ওদিকে যদি ভালো সিনেমা বানায় তরুণ প্রজন্মের পরিচালকেরা, তাহলেই ঘুরে দাঁড়াবে দেশজ শোবিজ অঙ্গন। ইতিমধ্যে আমরা বেশ কয়েকজন তরুণ পরিচালকের কাজ দেখেছি। তাঁরা আশা জাগানিয়া বেশ কিছু কাজ করেছেন। তাদের চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে।

একদিকে সিনেমা প্রদর্শনের নতুনত্ব, অন্য দিকে সিনেমা তৈরির দিকে তরুণ পরিচালকদের আকাশচুম্বী আগ্রহ— দুইয়ে মিলে নতুন এক যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশ। বিশ্ব এর আগেই পৌঁছে গেছে চলচ্চিত্র শিল্পের সেই সোনালী যুগে। এবার শুধু আমাদের এগিয়ে চলাটা বাকি।

চীনে প্রতিদিন নতুন নতুন স্ক্রিন। পুরো চীনে এখন প্রদর্শন স্ক্রিনের সংখ্যা প্রায় ৫৪ হাজার। ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্ক্রিনের সংখ্যা ছিল ৪০ হাজার ৬০৪টা। ২০২০ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজার ৯৯৮টা।

ভারতে সিঙ্গেল স্ক্রিন এখন প্রায় ১১ হাজার। প্রায় আড়াই হাজার স্ক্রিন বেড়ে গেছে গত পাঁচ বছরে, যেগুলোর বেশিরভাগই সিনেপ্লেক্স। সিনেমা হলের সংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম দেশ এই ভারত। সিনেপ্লেক্স বেড়ে চলেছে মেক্সিকো, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে।

বাংলাদেশে ২০১৬ সালে সাড়ে ৩০০ এর মতো সিনেমা হল ছিল। এ বছর ঈদে ২০০ এর মতো সিনেমা হলে ঈদের ছবি চলেছে। তবে মাল্টিপ্লেক্স বাড়ছে। সম্প্রতি ব্যাংক ঋণের জন্য আবেদন করেছেন ২৩ টি মাল্টিপ্লেক্স কর্তৃপক্ষ। দে‌শে সিঙ্গেল স্ক্রিন কমলেও মাল্টিপ্লেক্স বেড়ে যাচ্ছে অচিরেই।

পৃথিবীর পরিসংখ্যান বলছে, সিনেমা হলের ওপর এখনও আস্থা আছে ব্যবসায়ীদের। ছোট পরিসরে নির্মিত হচ্ছে প্রচুর থিয়েটার। আগের দিনের বিশাল দর্শক-ধারণসংখ্যার সিঙ্গেল স্ক্রিন মার খাচ্ছে। কিন্তু মাল্টিপ্লেক্স ডিজিটাল স্ক্রিন তৈরি বন্ধ নেই, বরং বেড়ে চলেছে প্রতিটি দেশেই।

অথচ নেটফ্লিক্স-বিপ্লবের যুগে সিনেমা হলগুলো মুখ থুবড়ে পড়বার কথা ছিল। মুখ থুবড়ে পড়েছেও, তবে সেগুলো মান্দাতা আমলের প্রেক্ষাগৃহগুলো। মাল্টিপ্লেক্সের জন্য নেটফ্লিক্স একটি হুমকি ছিলো মাত্র। বিশ্বের লাখ লাখ সিনেমা হল সেই হুমকি মোকাবিলার জন্য আটঘাঁট বেঁধে প্রস্তুতও হচ্ছে। অ্যামাজন, জি ফাইভ, সনিলিভ, হটস্টার— এক ভারতেই কয়েক ডজন অ্যাপ বাজারদখলে মরিয়া। নিত্যনতুন কন্টেন্টের পসরা সাজিয়ে ঘরের ভেতর দর্শকদের আটকে রাখতে স‌চেষ্ট এই ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলো। কিন্তু পারেনি তাঁরা। সিনেমা হলে দর্শক ছুটছেই। করোনার ঘরবন্দি সময়ে ওটিটির জনপ্রিয়তা বাড়লেও, পৃথিবী স্বাভাবিক হতে না হতেই সিনেমা হলের ম্যাজিক পুনরায় তাঁর সম্মোহন বিস্তার করেছে।

ভারতে একেকটি সিনেমা এখন শতকোটি রুপি ব্যবসা করে চলেছে। কার্তিক আরিয়ানদের মতো অখ্যাত নায়কেরা ব‌লিউ‌ডে তারকা হ‌তে পেরে‌ছে মা‌ল্টি‌প্লে‌ক্স সিনে কালচারের কল‌্যা‌ণেই। এই ধারায় হলিউডের কথা যদি তোলা হয়, সে আলোচনা বিশাল আলোচনা হয়ে যাবে। 'ডক্টর স্ট্রেঞ্জারস' এক ভারতে এসেই ব্যবসা করেছে শত কোটি রুপির ওপরে। বাংলাদেশেও তাঁরা দেদার ব্যবসা করেছে। অগ্রিম টিকেট বিক্রির দিন দর্শকদের উন্মাদনা দে‌খে চলচ্চিত্র শিল্পের যে কোনো উদ্যোক্তাই আশায় বুক বাঁধবেন।

নেটফ্লিক্সসহ অন্যান্য ওটিটি তাঁদের মতো ব্যবসা করবে। এই ব্যবসা বাড়বে বৈ কমবে না। অন্যদিকে দলবেঁধে হলে গিয়ে সিনেমা দেখাও চলবে। ধীরে ধীরে মাল্টিপ্লেক্সের টিকেটের দামও সাধারণের সাধ্যের মধ্যে আসবে। আগামী দিন যেমন ওভার দ্য টপ প্ল্যাটফর্মের, তেমনই সিনেমা হলের হয়ে উঠবে।

একটি দেশ শুধু একটি মানচিত্র, একটি পতাকা আর শাসনব্যবস্থার মাধ্যমেই টিকে থাকে না। তাঁর চাই মজবুত একটি সাংস্কৃতিক পরিচয়। গাছের যেমন গোড়া থাকা দরকার, ঠিক তেমনই সাংস্কৃতিক পরিচয় হলো একটি দেশের শেকড় বা গোড়া। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশের সমকাল এখন তীব্র সাংস্কৃতিক শূণ্যতায় ভুগছে। তরুণ সমাজের একটি অংশ স্মার্ট হবার বাসনায় পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ করছে, আরেকটি অংশ ধর্মচেতনার নামে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতিতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। হাজার বছরের সমৃদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতি এ দেশের তরুণেরা ভুলতে বসেছে।

এ অবস্থায় বাংলা সিনেমার এই জয়জয়াকার আমাদের আশা দেখাচ্ছে। কারণ, দেশজ সংস্কৃতি তুলে ধরবার বড় এক হাতিয়ারের নাম হলো চলচ্চিত্র। বাংলা চলচ্চিত্র শিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াক, এই প্রত্যাশা আমাদের।

লেখক: সম্পাদক, দ্য রিপোর্ট

Link copied!