বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর গল্প: একটি সেতুর চেয়েও বেশি কিছু?

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জুন ৮, ২০২২, ১০:০৬ এএম

বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর গল্প: একটি সেতুর চেয়েও বেশি কিছু?

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করে পাকিস্তানের শীর্ষ স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডেইলি টাইমসে এবটি নিবন্ধ লিখেছেন পাঞ্জাবের শিক্ষাবিদ, গবেষক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড.মালিকা-ই-আবিদা খাত্তাক। তাঁর নিবন্ধে পদ্মা সেতু নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আত্মবিশ্বাস, দূরদর্শিতা আর নিজস্ব অর্থায়নের সাহসী সিদ্ধান্তের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। দ্য রিপোর্ট ডট লাইভের পাঠকদের জন্য তার নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে বাংলায় তুলে ধরা হলো। 

‘আগামী ২৫ জুন উদ্বোধন হচ্ছে বাংলাদেশের বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু। ওইদিন সকাল ১০টায় বহুল প্রতীক্ষিত সেতুটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওয়াজেদ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ টি জেলার যাত্রীরা দেশের বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে ফেরি দিয়ে পদ্মা নদী পার হন। দীর্ঘ যানজটে ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রী ও চালকদের। সেতুটি চালু হলে এটি হবে বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু এবং সড়ক চলাচলের জন্য প্রথম নির্দিষ্ট নদী পারাপার। দ্বি-স্তরের স্টিল ট্রাস সেতুটি উপরের স্তরে একটি চার লেনের মহাসড়ক এবং নীচের স্তরে একটি একক-ট্র্যাক রেলপথ বহন করছে। 

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের লাখো মানুষের স্বপ্নের পদ্মা সেতু চলতি মাসেই উদ্বোধন হতে যাচ্ছে, শিগগিরই মানুষের দুর্ভোগের অবসান ঘটবে। বহুমুখী সেতুটি যাত্রী ও মালবাহী যানবাহনের জন্য যাত্রা সহজ করবে এবং ধীরে ধীরে দেশের জিডিপি এক দশমিক তিন থেকে দুই শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।উপরের দিকে স্টিল-ট্রাস কম্পোজিট কিপিং রোড এবং নীচে রেলসহ দুই স্তরের পদ্মা সেতুটি  বিশ্বের গভীরতম ভিত্তি সেতু।

২৫ জুন পূর্ব দিকে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি বিশাল জনসভায় ভাষণ দেবেন। এটি হবে ২০১৮ সালের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তার প্রথম জনসভা।

দেশের উন্নয়নের মূর্তিমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মতো বিশ্ব দৃষ্টান্ত তৈরি করে আত্মবিশ্বাস ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। বিশাল প্রতিবন্ধকতার পথ তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে। তবে তিনি তাঁর গন্তব্যে পৌঁছেছেন। পদ্মা সেতু তৈরি নিয়ে সব ষড়যন্ত্র দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করে শেখ হাসিনা সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বাক্ষর বহন করে এই পদ্মা সেতু। তাঁর সরকারের সময় বাংলাদেশের সক্ষমতা আরও একবার জানার সুযোগ পেল বিশ্ববাসী। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যারা বারবার তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে।

পদ্মা সেতু নির্মাণের শুরুর দিকের চিত্রগুলোতে চোখ বুলালে দেখা যায়, সেতু নির্মাণে অর্থায়ন করার ঘোষণা দিয়েও পরে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ তুলে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের দেখানো পথ অনুসরণ করে অন্যান্য দাতা সংস্থা ও আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।  

বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভবিষৎত বেশ হুমকির মুখে পড়ে। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে সেতুর নির্মাণ কাজ। শুধু তাই নয়, ওই সময় শেখ হাসিনার  সমালোচকরা হাসিতে  ফেটে পড়েন। ‘পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব হবে ন ‘ বলেও তারা নেতিবাচক মন্তব্যের ঝড় তোলেন। তবে পদ্মা সেতু তৈরির আগেই দুর্নীতি বা ঘুষ ষড়যন্ত্র  নিয়ে যে প্রশ্ন তোলে বিশ্বব্যাংক, সেই দুর্নীতির কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি কানাডার আদালত। বরং দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ ওঠায় ওই সময়কার যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।

পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর দেখা যায় নানাবিধ সমস্যা।  আসতে থাকে বড় বড় একাধিক চ্যালেঞ্জ। নদী শাসন এবং পাইলিংয়ের ক্ষেত্রে সাহসী এবং যুগান্তকারী প্রকৌশল দক্ষতা প্রয়োজন ছিল। একই সময়ে, নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যেই আঘাত হানে করোনাভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ। করোনায় দেশের বেশিরভাগ কর্মক্ষেত্রে স্থবিরতা বিরাজ করলেও শেখ হাসিনা ওয়াজেদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণে একদিনের জন্যও কাজ বন্ধ হয়নি। করোনা মোকাবিলার পাশপাশি পদ্মা সেতুর কাজও এগিয়ে নেওয়া হয়েছে।

সমালোচকরা যখন দেখলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মা সেতুর কোজ বিরামহীনভাবে এগিয়ে চলছে, তখন বেশ কয়েকজন অসাধু ষড়যন্ত্রকারী গুজব ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ওইসময় গুজব ছড়ানো হয়, পদ্মা সেতু তৈরিতে মানুষের মাথা লাগবে। ওই গুজবও শেখ হাসিনার সরকার দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছাশক্তির কারণেই শুধুমাত্র পদ্মা সেতু নয় মেট্রোরেল ও দেশের সবচেয়ে বড় টানেলের কাজও প্রায় শেষের দিকে। এসব প্রকল্প চলতি বছরই জনগণের জন্য উম্মুক্ত করা হবে।

বেশ কয়েকটি মেগা প্রজেক্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি প্রকল্প, যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু নির্মাণ, পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরী নির্মাণ। তবে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং ছিল পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প। পদ্মা সেতু শুধুমাত্র একটি সেতু নয়,  এটি দেশের একটি বড় সম্পদ। 

পদ্মা সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এটি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে যুক্ত করবে। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর শুরু হয় ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থের এই সেতুর নির্মাণ কাজ।

পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। গর্ব ও অহঙ্কারের সেতু আজ দাঁড়িয়ে আছে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি অদম্য ও সাহসী সিদ্ধান্ত তাকে একজন আত্মবিশ্বাসী, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি, ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং বিভিন্ন সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থানের উন্নতি আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। প্রধানমন্ত্রী এই সেতুর জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সাফল্য সেই ত্যাগকে যৌক্তিক করেছে।

পদ্মা সেতু নির্মানে প্রাথমিকভাবে নির্মাণ খরচ কম ছিল। তবে পরবর্তীতে বেশ কয়েক ধাপে বেড়ে সর্বশেষ প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৮ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। এর পুরো টাকাই সরকারি অর্থায়ন। পদ্মা সেতুর নির্মাণ সময় ও খরচ বৃদ্ধি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত থাকলেও সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে- সেতু তৈরির কাজ শেষ হয়েছে এবং জুন মাসের মধ্যে জনগণের জন্য উম্মুক্ত করা হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক ঘটনার সাথে গভীরভাবে জড়িত এই পদ্মা সেতু। এই  সেতৃর নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ ছিল। এই সেতু চালু হলে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠার পাশপাশি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোও বদলে যাবে। পদ্মা সেতু কৃষিতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে রাজধানীতে কৃষিপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক অধ্যায়ের সৃষ্টি করবে। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ভালো দাম পাবেন। পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ব্যাপক শিল্পায়ন ঘটবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। আর এই সেতু হয়ে উঠতে পারে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের একটি অংশ।

পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের যোগাযোগ ও পরিবহন ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটার পাশপাশি পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন হবে। পদ্মা সেতুর মুন্সীগঞ্জ ও শরীয়তপুর অংশে একটি ৬ লেনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে যা খুবই নজরকাড়া ও চিত্তাকর্ষক। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অনন্য ভূমিকা রাখবে এই সেতু। পদ্মা সেতুর চারপাশে গড়ে তোলা হবে রিসোর্ট, হোটেল ও রেস্তোরাঁ। এসব হোটেল ও রেস্তরায় বাঙালি খাবার পরিবেশন করা হবে। আর এর মাধ্যমে বিদেশীদের কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে আরও ভালোভাবে তুলে ধরা যাবে। দেশের জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ও বেড়ে যাবে এই পদ্মা সেতুর কারণে।

পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রেল যোগাযোগ আরও উন্নত হবে। জনগণ ঢাকা থেকে অল্পসময়ে স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারবেন। সেতুকে ঘিরে গড়ে উঠবে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এতে করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান বহুগুণ বেড়ে যাবে।

পদ্মা সেতুর নামের সাথে শেখ হাসিনার নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পদ্মা সেতুর নাম উচ্চারণ করলে শেখ হাসিনা ওয়াজেদের নাম উচ্চারণ করতে হবে। তাঁর নামে এটির নামকরণ না হলেও প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মানুষ জানতে পারবে পদ্মা সেতুটি তার কারণেই সম্ভব হয়েছে।

পদ্মা সেতুর বড় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে জয়ী হয়েছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। পদ্মা সেতু দেশকে দ্রুত উন্নতির দিকে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যেতে এই সেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাওয়া বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা বহুমুখী সেতু বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করার পাশপাশি জাতির আস্থাকেও শক্তিশালী ও দৃঢ় করেছে।’

ভাষান্তর: মিজানুর রহমান খান

Link copied!