মহামারি যেভাবে গণতন্ত্রকে বদলে দিচ্ছে

দ্য রিপোর্ট ডেস্ক

জানুয়ারি ৬, ২০২২, ০৯:৫৭ পিএম

মহামারি যেভাবে গণতন্ত্রকে বদলে দিচ্ছে

কোভিড মহামারির শুরু হয়েছিল জনগণকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা এবং দীর্ঘ-ক্লান্তিকর লকডাউনি দিয়ে। তারপর ক্রমশ তা বিনোদন অঙ্গন থেকে ক্রীড়াঙ্গন কোনটাকেই ছাড় দেয়নি। যার ফলে, বিশ্বের বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী গণতান্ত্রিক দেশেও গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার সংকুচিত করেছে।   

পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে ইউরোপিয় দেশগুলো করোনা ভাইরাস ঠেকানোর নামে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সংকুচিত করেছে। সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো দেশটির যেসব নাগরিক ভ্যাকসিন নিতে অস্বীকার করেছে তাদের ‘সামাজিক চলাফেরা সংকুচিত’ করার মাধ্যমে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু তাতে ফল হয়েছে উল্টো। লোকজন তার এমন বক্তব্যের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছে।

যে দেশটি নিজেকে স্বাধীনতার বৈশ্বিক আলোকবর্তিকা মনে করে সেরকম একটি দেশের নেতার এমন মন্তব্য বুঝায় যে, চলমান মহামারি জাতীয় অগ্রাধিকারগুলিকে কতটা বদলে দিয়েছে।

কেবল ফ্রান্স নয় যুক্তরাষ্ট্রও দেশটির সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার মতো বেশ কিছু আগ্রাসি পদক্ষেপ নিয়েছিল। দেশটি প্রায় ২০ মাস তাদের সীমান্ত বন্ধ করে রেখেছিল। যা বিশ্বের মধ্য সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও সরকারি ও বড় বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের জন্য ভ্যাকসিন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করেছিল।

বার্লিনভিত্তিক  মানবাধিকার সংগঠন সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন ফর ইউরোপ গত বছরের একটি প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, ভ্যাকসিন গ্রহণে অনিচ্ছুকদের উদ্দেশ্য করে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে তা ভবিষ্যতে ‘বিদ্যমান বৈষম্যকে আরও বৃদ্ধি করবে’। এর ফলে, একটি দুই স্তর বিশিষ্ট সমাজেব্যবস্থা তৈরি হতে পারে। যেখানে কিছু মানুষ মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা ভোগ করবে আর কিছু মানুষ কোন সুবিধাই পাবে না।

মহামারির শুরুতে দেশগুলো লকডাউন-কারফিউ জারি করে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু বিগত বছরে, দেশগুলো তাদের কৌশল বদলে ফেলে। লকডাউন কিংবা কারফিউয়ের বদলে তারা নাগরিক সেবা পাওয়ার জন্য ভ্যাকসিন নেওয়ার প্রমাণ দেখাতে বাধ্যতামূলক করে।

এদিকে, ওমিক্রনকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু দেশের সরকার বিশেষ করে নেদারল্যান্ডস এবং অস্ট্রিয়ার সরকার তাদের জনগণকে ইংরেজি নববর্ষ পালনের উৎসব থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে। এর বাইরেও, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই ভ্যাকসিন গ্রহণে অস্বীকারকারিদের টিকা নিতে ভয় ভীতি প্রদর্শন করছে।

অস্ট্রিয়া দেশটিতে লকডাউন আংশিকভাবে তুলে নেওয়ার পরও যারা ভ্যাকসিন নেয়নি তাদের ঘরে থাকতে বাধ্য করছে। এমনকি, আগামি ফেব্রুয়ারি মানে ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে সবার জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জার্মান সরকারের সিদ্ধান্ত অনুকরণে বলেছেন, তাদের দেশেও সবার জন্য ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করতে ‘জাতীয় সংলাপ’ প্রয়োজন। পক্ষান্তরে, জার্মানিকে অনুকরণ করে ফ্রান্স ইতোমধ্যে ভ্যাকসিন না গ্রহণকারিদের রেঁস্তোরা, সিনেমা এবং পর্যটনস্থলগুলোতে যাতায়াত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছে।

তবে, মহামারির প্রথম দিকে জনগণ সঙ্কট মোকাবেলায় সকল বিধিনিষেধ মেনে নিলেও মহামারির দীর্ঘ ক্লান্তি তাদের প্রতিরোধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। প্রতিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ভ্যাকসিন না নেওয়া অনেকেই তাদের সঙ্গে হওয়া রাষ্ট্রীয় বৈষম্যকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইহুদিদের সঙ্গে হওয়া বৈষম্যের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এবং নেদারল্যান্ডস থেকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি থেকে বেলজিয়াম কিংবা ফ্রান্স; ইউরোপের সর্বত্রই জনগণ কোভিড সংক্রান্ত নিয়ম এবং ‘হেলথ পাস’-এর বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে তো জনগণের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষও হয়েছে।

তবে অতি-ডান, অতি-বাম এবং হস্তক্ষেপবাদী নীতির বিরোধিতাকারী দলগুলি এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে সরকারগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। জার্মানিতে গত সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে লকডাউনের কড়াকড়ির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রচারণা চালানো দলগুলো বেশ সাফল্য লাভ করেছে। ফ্রান্সে আগামি এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দুই অতি-ডানপন্থী প্রার্থী মেরি পেন এবং এরিক জিমার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রোর ‘ভ্যাকসিন পাস’ নীতির কড়া বিরোধিতা করেছেন।  

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান ২০২১ সালের মার্চে সতর্ক করে বলেছিল, “কোভিড ঠেকাতে বিধিনিষেধ জরুরি কিন্তু সেসব বিধিনিষেধে কি কি থাকছে এবং তা কিভাবে আরোপিত হচ্ছে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। এবং যারা টিকা নিতে চায় না, যারা ব্যক্তির স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে তাদের স্বাধীনতাও যেন লঙ্ঘিত না হয়।” কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ইউরোপের বেশিরভাগ অংশেই জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণ এবং জনসাধারণের অধিকার সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার কোন চেষ্টাই করেনি।

ইউরোপসহ বিশ্বের ৪০ টি দেশের লকডাউন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে ফ্রান্সের রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক রাউল ম্যাগনি বার্টন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এর ফলে প্রতিটি দেশেই নাগিরিক স্বাধীনতার ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। তার গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, যেসব দেশ এই মহামারির মধ্যেও নাগরিক স্বাধীনতাকে সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো গণতন্ত্রের দেশ বিশেষ করে ব্রিটেন ও সুইজারল্যান্ড অন্যতম। তার গবেষণা থেকে আরও জানা যাচ্ছে যে, যেসব দেশে কোয়ালিশন বা জোট সরকার ক্ষমতায় সেখানেও তুলনামূলকভাবে জনগণের অধিকারের প্রতি বেশি সচেতন ছিল তারা। বিধিনিষেধও অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। এক্ষেত্রে তিনি নেদারল্যান্ডসে ও জার্মানির কথা উল্লেখ করেছেন।

তবে ম্যাগনি বার্টন প্রশ্ন রেখেছেন, আসলে এসব দেশে কতোজন নাগরিক রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন।

(এএফপি অবলম্বনে)

Link copied!