বছরখানেক আগেও রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবার পেয়ে আসছিল বীরের মর্যাদা। কারণ দেশবাসীর মতে, তামিল টাইগারদের সাথে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন তাঁরা। সেই রাজাপক্ষে পরিবারই এখন যেন গণশত্রু, সব সংকটের গোড়া।
স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। জ্বালানি, বিদ্যুৎ, রান্নার তেল-গ্যাসসহ নিত্যপণ্যের সংকটে প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষের জীবন অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই দ্বীপরাষ্ট্রের নাগরিকদের ক্ষোভ কেন্দ্রীভূত হয়েছে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবারের ওপর। শ্রীলঙ্কান জনগণের মতে রাজাপক্ষের পরিবার একসময়ের যুদ্ধনায়ক থেকে বর্তমানে খলনায়কে পরিণত হয়েছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শ্রীলংকার রাজনীতিতে রাজাপক্ষে পরিবারের ছিল বিরাট আধিপত্য। শ্রীলংকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি জাতিগোষ্ঠীর কাছে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছিলেন বীর নায়ক। প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের নির্মমভাবে দমনের মাধ্যমে তিন দশক ধরে চলা গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি টানেন তিনি।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যেসব বড় বড় বিজয় শোভাযাত্রা এবং জনসভা হয়েছিল, সেগুলোতে রাজাপক্ষেকে সিংহলি বৌদ্ধ রাজাদের সঙ্গে তুলনা করা হতো। শ্রীলঙ্কানদের অনেকে সম্রাট মাহিন্দা বলেও প্রশংসা করতো।"
২০০৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হন মাহিন্দা রাজাপক্ষে। এক বছর পর তিনি যখন প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হন, তখন তার ভাই বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়াকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। ওই সময় গোতাবায়া সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছিলেন। রাজনীতিতে গোতাবায়ার এটা ছিল এক বিরাট রাজনৈতিক উত্থান।
সরকারে যোগ দিয়ে গোতাবায়া বিরাট খ্যাতি অর্জন করলেন তার নিষ্ঠুরতার জন্য। এরপর রাজাপক্ষের পরিবারের আরও অনেক ভাই এবং আত্মীয়-স্বজন সরকারে যোগ দিলেন। তবে রাজাপক্ষে সাম্রাজ্যের মূল ব্যক্তি ছিলেন মাহিন্দা, বলা যেতে পারে তিনিই এই সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।
তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশটির দু'কোটি ২০ লাখ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বাধ্য হয়ে এপ্রিলের শুরু থেকে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া এবং প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবি জানাতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে দায়ী করা হচ্ছিল।
সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর মাহিন্দা রাজাপক্ষের সমর্থকরা হামলা চালানোর পর দেশজুড়ে তীব্র সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী রাজাপক্ষেকে পদত্যাগ করতে হয়। এক ডজনেরও বেশি রাজনীতিকের বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হলো- এর মধ্যে কিছু বাড়ি ছিল রাজাপক্ষেদের।
রাজাপক্ষের সরকারি বাসভবনও ঘেরাও করেছিল। পরে সেখান থেকে নিজের নিরাপত্তার জন্য শ্রীলংকার উত্তর-পূর্বে একটি নৌ-ঘাঁটিতে গিয়ে লুকিয়ে আছেন। শ্রীলংকার আদালত তার দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যিনি দুই দুইবার শ্রীলংকার প্রেসিডেন্টও ছিলেন, তার জন্য এটি এক বিরাট অবমাননা।
কিন্তু পদত্যাগ করে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালেও মানুষের ক্ষোভ কমেনি। এবার তার ৭২-বছর বয়সী ছোট ভাই, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা অটল।
তবে পদত্যাগের দাবি উপেক্ষা করে এখনও ক্ষমতা আকড়ে ধরে রেখেছেন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। সর্বদলীয় সরকার গঠনের লক্ষ্যে ঝানু রাজনীতিক রনিল বিক্রমাসিংহেকে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিলেও গোতাবায়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো সুতায় ঝুলছে। অনেকে মনে করেন, তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মাহিন্দা রাজাপক্ষে বিদায় নেওয়ায় হয়তো বিক্ষোভকারীরা খুশি, তবে গোতাবায়াকেও ক্ষমতা থেকে তাড়াতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যে ভোটারদের সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছিলেন, সেই সমর্থন হারানোর পর গোতাবায়া এখন কি করবেন, তা স্পষ্ট নয়। শ্রীলংকার মানুষও তাদের ধৈর্য হারাচ্ছেন। যত দিন গড়াচ্ছে ততই গোতাবায়ার বিরুদ্ধে জনগণ ততই ফুঁসে উঠছেন।