সংগীত শাস্ত্রের প্রায় সব শাখাতেই তার ছিল অবাধ বিচরণ। হিন্দি সংগীতের অমর শিল্পী হিসেবেই ভারতীয় উপমহাদেশে পরিচিতি তার। তিনি শিল্পী মোহাম্মদ রফি। মধুঢালা বহুমুখী এক কণ্ঠ। আইটেম নাচের গান থেকে দেশাত্মবোধক, বিরহ থেকে রোম্যান্টিক, সুফি কাওয়ালি থেকে ভজন- সব ক্ষেত্রেই মুন্সিয়ানা ছিল তার। সুর সাধনা করতে করতেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন।
ব্রিটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরের কাছে কোটলা সুলতান সিংয়ে ১৯২৪ সালের এই দিনে (২৪ ডিসেম্বর) জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ রফি। ডাক নাম ফিকো। মাত্র ১৩ বছর বয়সে লাহোরের প্রথিতযশা শিল্পী কে এল সাইগলের সাথে প্রথমবারের মতো তিনি কনসার্টে সংগীত পরিবেশন করেন।
১৯৪১ সালে লাহোরে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নিজেকে অভিষেক ঘটান। পাঞ্জাবী ভাষায় নির্মিত গুল বালুচ (১৯৪৪ সালে মুক্তি পায়) চলচ্চিত্রে জিনাত বেগমের সঙ্গে দ্বৈত সঙ্গীত "সোনিয়ে নি, হেরিয়ে নি" গানটি গান। একই বছরে মোহাম্মদ রফি অল ইন্ডিয়া রেডিও'র লাহোর সম্প্রচার কেন্দ্রে গান পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রণ পান।
১৯৪১ সালে শ্যাম সুন্দরের পরিচালনায় ‘গুল বালোচ’ ছবির মাধ্যমে সঙ্গীতে পেশাগতভাবে অভিষেক ঘটান রফি। পরের বছর বোম্বের চলচ্চিত্র ‘গাও কি গৌরী’ ছবিতে নৈপথ্য গায়ক হিসেবে করেন বাজিমাৎ। এছাড়াও রফি ‘লায়লা-মজনু (১৯৪৫) এবং ‘জুগনু ‘ চলচ্চিত্রে সংক্ষিপ্তভাবে, অতিথি শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। লায়লা-মজনু চলচ্চিত্রে 'তেরা জ্বালা' কোরাস গানে তাকে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে গাইতে দেখা যায়।
মোহাম্মদ রফি তার সুদীর্ঘ সংগীত জীবনে অনেক নামকরা সঙ্গীত পরিচালকের দিক-নির্দেশনায় বিভিন্ন ধরনের গান গেয়েছেন। তার মধ্যে অমর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নওশাদের পরিচালনায়ই গান গেয়েছেন বেশি। এছাড়াও, ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে ওপি নয়াার, শঙ্কর জয়কিশান, এসডি বর্মন, গীতিকার মদন মোহনসহ প্রখ্যাত সুরকার ও গীতিকারের সঙ্গে কাজ করেছেন।
সমসাময়িক শিল্পীদের সাথে রফি
লতা মুঙ্গেশকরের সঙ্গে তাঁর জুটি এক অবিস্মরণীয় সাফল্য আর খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছেছিল ৷ লতা-রফি জুটিকে বলিউড ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ জুটি ধরা হয়। তারা ১৯৪৯ সালে ‘বারসাত’ ছবি থেকে শুরু করে এক নাগাড়ে রফি মৃত্যু পর্যন্ত ৫০০ এর অধিক দ্বৈত গানে অংশ নেন। লতার সাথে রফির সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-রঙ্গ-রসিকতার এক অপূর্ব মিশ্রণ ৷ লতা বিশ্বাস করতেন, “রফি যে কোনো বয়সের নায়কের জন্যই গাইতে পারতেন ৷ শুধু তাই নয়, লতা মনে করতেন রফি অসাধারণ একজন গাইয়ে ছাড়াও আচার-আচরণে-ভাবনায় যেন স্বয়ং ঈশ্বরেরই এক প্রতিনিধি ৷” এক সাক্ষাৎকারে লতা মুঙ্গেশকর মোহাম্মদ রফি সম্পর্কে বলেন, “একশো বছরেও মোহাম্মদ রফির মতো কণ্ঠ আর আসবে না৷”
আশা ভোঁসলের সাথে রফির জুটিকে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জুটি বলা হয়। তারা ১৯৫০-৮৭ সাল পর্যন্ত সঙ্গীতে যুক্ত ছিলেন (১৯৮০ সালে তার মৃত্যুর পর এক দশক পর্যন্ত রফির গান মুক্তি পেতে থাকে)। আশা ভোঁসলে আর মোহাম্মদ রফি মোট ৯১৮টি দ্বৈত গানে কণ্ঠ দিয়েছেন, যা বলিউডের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
রফির সমসাময়িক শিল্পীদের মধ্যে কে সেরা তা নিয়ে বিতর্ক উঠলে কিশোর কুমার নিজেই ওই বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে বলেন, “মোহাম্মদ রফি হলেন আমাদের সময়কার সবচেয়ে সেরা পুরুষ কন্ঠ।” রাগিনী চলচ্চিত্রের ‘মানমারা বাউরা’ কিংবা ‘আজিব দাস্তাপন হে মেরির’ গানগুলো গাওয়ার সময় সমস্যার মুখোমুখি হলে সংগীত পরিচালককে ওই গানগুলো রফিকে দিয়ে করানোর অনুরোধ করেছিলেন।
মোহাম্মদ রফিকে গুরু হিসেবে স্বীকার করেছেন আরেক প্রখ্যাত শিল্পী মান্না দে। রফি সম্পর্কে এক সাক্ষাতকারে মান্না দে বলেছেন, “তিনি সকলের চেয়ে সেরা গায়ক ছিলেন। রফি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন ভদ্রলোক। তিনি আমার চেয়েও সেরা গায়ক ছিলেন এবং আমি অবশ্যই বলবো যে, কেউই তাঁকে স্পর্শ করতে পারবে না।”
হিন্দি চলচ্চিত্রের ডাকসাইটে অভিনেতা শাম্মী কাপুর বলেছিলেন, "আমি রফিকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমি যখনই গান রেকর্ড করতে যাই, তখনই মোহাম্মদ রফি'কে খুঁজে পাই।
লতা-রফি বিবাদ
ভাল বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড সংক্রান্ত গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে প্রখ্যাত সিংগীশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের নাম উঠলে রফি এর প্রতিবাদ জানিয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেন।
১৯৭৭ সালের ১১ জুন লেখা ওই চিঠিতে মোহাম্মদ রফি জানান, “লতাজী সবচেয়ে বেশি গান রেকর্ড করেছেন সত্য; কিন্তু তা গিনেস কর্তৃপক্ষের ভাষ্য মোতাবেক ২৫,০০০ গানের কম নয়।” একই বছর ১৯৭৭ সালের নভেম্বর মাসে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মোহাম্মদ রফি দাবি করেন, “তিনি ওই সময় পর্যন্ত ২৫ থেকে ২৬ হাজারের মতো গান গেয়েছেন।”
বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার
প্রায় চল্লিশ বছর সময়কাল ধরে সঙ্গীত জগতে থাকাকালীন চলচ্চিত্রের ২৬ হাজারেরও অধিক গানে নেপথ্য গায়ক হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন মোহাম্মদ রফি। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, বিরহ-বিচ্ছেদ, উচ্চ মার্গের প্রেম-ভালবাসা, কাওয়ালী, ভজন, গজল-সহ বিভিন্ন গোত্রের গানে দক্ষতা ও পারদর্শিতা দেখিয়েছেন সমানভাবে। বিশেষ করে হিন্দি ও উর্দু ভাষায় সমান দক্ষতা থাকায় তার গানগুলোতে বৈচিত্র্য এসেছে সমধিক।
হিন্দিসহ উর্দু, ভোজপুরী, উড়িয়া, পাঞ্জাবী, বাংলা, মারাঠী, সিন্ধী, কানাড়া, গুজরাতি, তেলেগু, মাঘী, মৈথিলী, অহমীয়া ইত্যাদি ভাষায় তিনি গান গেয়েছেন। এছাড়াও আরও গান গেয়েছেন- ইংরেজি, ফার্সী, স্প্যানিশ এবং ডাচ ভাষায়।
বাংলাভাষাতেও তার বেশ কিছু জনপ্রিয় গান রয়েছে। ‘ওরে মনকে এমন দাগা দিয়ে’, ‘ওই দূর দিগন্ত পারে’, ‘নাই বা পরিলে আজ মালা চন্দন’, ‘কথা ছিল দেখা হবে’, ‘এ জীবনে যদি আর কোনো দিন’, ‘নওল কিশোর’, ‘কালো কলেবর কানহাই’, ইত্যাদি গান এখনো শ্রোতাদের মন ভরায়। তাঁর কণ্ঠে নজরুল সংগীত ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’ গায়কিতে আজও অনন্য।
সঙ্গীত কলায় অসামান্য অবদান রাখায় মোহাম্মদ রফিকে শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবে জাতীয় পদক দেওয়াসহ ১৯৬৭ সালে ভারত সরকার পদ্মশ্রী সম্মানেও তাকে ভূষিত করে।
মৃত্যু
১৯৮০ সালের ৩১ জুলাই। মোহাম্মদ রফি সেদিনও গিয়েছিলেন স্টুডিওতে গান রিহার্সেল করতে। তার শারীরিক অবস্থা দেখে সবাই তাকে বিশ্রাম এবং ডাক্তারের কাছে যেতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি সঙ্গীতপ্রেমে বিভোর তখনও। সঙ্গীতাসক্ত মানুষটি সবাইকে অনুরোধ করেন মিওজিক বাজাতে। গানের রিহার্সেল যত চলতে থাকল, তার শরীরও আরও খারাপ হতে থাকল। নেওয়া হল হাসপাতালে। সেই যে সুরসাগরে চিরদিনের জন্য ডুব দিলেন রফি, আর ফিরলেন না।
মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ম্যাসিভ হাট অ্যাটাকে এভাবে না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর খবরে মুষড়ে পড়ে গোটা দেশ। শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দুই দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করে সরকার।
মোহাম্মদ রফি নেই, কিন্তু আজও সংগীত পিপাসু মানুষের কাছে এখনও অমর তিনি। সঙ্গীতাকাশে এখনও ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলছেন বলিউডের এই অর্ফিউস।