বাংলা সাহিত্যে, আমাদের দেখা ও বোঝার শক্তিতে, আমাদের লড়াইয়ের দিগন্তজুড়ে কিছু মানুষ থাকেন যারা ‘প্রকৃত মানুষ’ হয়ে বেঁচে থাকেন আমাদের সত্ত্বায়। নির্দিষ্ট গন্ডিতে শিল্প নির্মাণে অসামান্য অবদান রেখে হয়ে পড়েন ‘শিল্পী’। আর প্রকৃত শিল্পী প্রতিক্ষণে বিচারের দিকে যান। তাকে যদি কিছুর পক্ষপাতই নিতে হয়, তবে অবশ্যই সৃষ্টিশীল সমাজের দিকেই থাকে তার মনোদৃষ্টি ।
এমনই সৃষ্টিশীল দুজন ব্যক্তিত্ত্ব আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও আলবেয়ার কাম্যুর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। এ দুজন গুণী মানুষ সম্পর্কেই এই প্রতিবেদন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, "কী পশ্চিম বাংলা কী বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।" লিখেছেন, "ইলিয়াস-এর পায়ের নখের তুল্য কিছু লিখতে পারলে আমি ধন্য হতাম।"
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস একজন স্বল্পপ্রজ লেখক ছিলেন। জীবিতাবস্থায় চারটি গল্প সংকলন, দুটি উপন্যাস ও একটি প্রবন্ধ সংকলন—এই তার সীমানা। কলেবর বিচারে হয়তো কম, তবে মান বিচারে পৃথিবীর সেরা লেখকদের কৃতিতুল্য কথাটা জোর গলায় বলতে আটকায় না।
বাস্তবতার নিপুণ চিত্রণ, ইতিহাস ও রাজনৈতিক জ্ঞান, গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ তার রচনাকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী সুষমা। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্'র পরেই তিনি সর্বাধিক প্রশংসিত বাংলাদেশী লেখক। তাকে সমাজবাস্তবতার অনন্যসাধারণ রূপকার বলা হয়েছে।
আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৪৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম মঞ্জু।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন এই লেখক। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন তিনি। তার লেখা- প্রতিশোধ, অন্য ঘরে অন্য স্বর, খোঁয়ারি, মিলির হাতে স্টেনগান, অপঘাত, জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল, রেইনকোট প্রভৃতি গল্পে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতা। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলেও সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে বাকশালে যোগ দেওয়ার চাপ থাকলেও যোগ দেন নি।
মৃত্যুর আগের ১৭ বছরে ইলিয়াস বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দুটি উপন্যাসসহ বেশ কিছু অসাধারণ গল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। মৃত্যুর আগের ১৩ বছরে হয়ে উঠেছিলেন অদম্য সংগঠকও। একজন মানুষের বেঁচে থাকা ও না থাকার মধ্যে কী তফাৎ তৈরি হয়, স্বজনদের মধ্যে কতটা শূন্যতা তৈরি হয়, সে অভিজ্ঞতা সবারই আছে। কিন্তু ইলিয়াসের মতো একজন মানুষের অকাল মৃত্যু পুরো একটা জনপদের, একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর এবং তার সাহিত্যের, তার জগৎকে নতুনভাবে নির্মাণের আবছা স্বপ্ন ও চলমান লড়াইয়ে যে কী অপূরণীয় ক্ষতি তৈরি করে, তা বলে বোঝানো কঠিন।
আলবেয়ার কাম্যু
আলবেয়ার কাম্যু একজন ফরাসি সাহিত্যিক ও দার্শনিক। আলবেয়ার কাম্য সাহিত্যের এমনই এক পর, যিনি তার সময়কে শৈল্পিকভাবে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। সামাজিক নানান সংকট, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, ঘরা, অভাব, যন্ত্রণাকে তিনি উপলব্ধির ভেতর আনতে চেয়েছেন। দ্রোহকে লালন করতে পছন্দ করতেন এর ভেতর দিয়ে বাঁচা-মরাকে অর্থবহ করতে চেয়েছেন, মূল্যবোধকে দাঁড় করাতে চেয়েছেন।
এমনই এক দার্শনিকের জন্ম ১৯১৩ সালের ৭ নভেম্বর, ফরাসির আলজেরিয়ার ছোট্ট শহর মন্দোভিতে। তিনি আলজিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন এবং পরে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। একইসাথে তিনি "তেয়াত্র দ্য লেকিপ' (Theatre de réquipe) নামে একটি তারুণ্যনির্ভর প্রগতিবাদী নাট্যদল সংগঠন করেন।
১৯৪১ সালে জার্মানি যখন ফ্রান্স দখল করে নেয়, সেইসময় তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন (Resistance movement)-এর নিয়মিত লেখা ও সম্পাদনার কাজ করে।
একজন পুরোধা বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠেন। গুপ্ত পত্রিকা কোঁবা (Combat 'লড়াই) প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেন।
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে তিনি লেখালেখিতে আত্মনিয়োগ করেন এবং লা পেন্ড (ইংরেজিতে The Plague) (১৯৪৭), লেজান্ড (ইংরেজিতে The Just) (১৯৪৯) ও লা শুাত (ইংরেজিতে The Fall) (১৯৫৬)-এর মত বই লিখে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন।
কাম্যু পাঁচটি উপন্যাস রচনা করেছেন। এগুলো হচ্ছে দা ফল (১৯৫৬), দ্য আউটসাইডার, দা স্ট্রেঞ্জার (১৯৪২) দাগে (১৯৪৭) অ্যা আাপি ডেথ (১৯৭১) এবং দ্য ফার্স্ট ম্যান (১১৯৯৫)। আমরা একেকটি উপন্যাসে একেক ধরনের আবহ পাই।
তার ‘দা ফল’ গ্রন্থটি হয়ে ওঠে এক আয়না, যেখানে মানুষ তার নিজেকে সমাজকে, এমনকি সভ্যতাকে চিহ্নিত করতে পারছে। এটি হচ্ছে এমন এক কখনশিল্প, যেখানে মানুষ তার জীবনকে বা সভ্যতাকে চিহ্নিত করে নিজেকেই হয়তো যাচাই-বাছাই করতে পারবে।
তার উপন্যাসগুলোর ভেতর ‘প্লেগ’ হচ্ছে দারুণ প্রতীকধর্মী। এখানকার কাহিনীতে কাম্যুর শৈশব আছে, আছে আলজেরিয়ার ওরান বন্দরে। সেখানে নেমে আসে এক ভয়াল জীবন কঠিন জটিল রোগ প্লেগ, যা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এ তো রোগ নয়, যেন ভয়ংকর জীবনের জীবন্ত প্রতীক। এ যেন এক পাপ যেন এক ধ্বংসকারী রূপক। একটা নগরকে একেবারে বদলে ফেলে জীবন বদলে যায় মানুষের চলাচলে পরিবর্তন ঘটে, যেন এক স্বৈরাচারের উত্থান।
এ উপন্যাসের ভেতর দিয়ে আমরা আশাবাদের কথাও শুনি, একসময় প্রেগও শেষ হতে থাকে। উপন্যাসে ডাক্তার রিও মুক্তি উৎসবের কথা জানান জীবনকে স্পর্শ করার গল্প বলেন। তিনি অনেকদিন হয়তো বাঁচবেন। প্রতিমৃত্যু কিংবা জীবন স্পর্শ করে করে তিনি যেন জেনে ফেলেছেন কেমন করে বাঁচতে হয়। এখানে জীবন আর নিবর্ধক থাকে না, আবেগাত্মকও হয়। সর্বত্র আনন্দধ্বনি ওঠে। প্লেগে মারা যাওয়া মানুষের জন্য একটা স্মৃতিস্তম্ভ গড়ার কথা জানা যায়। একেবারে শেষদিকে ডাক্তার কিছু কথা জানান। যে- রোগী মৃত্যুগন্ধী তা মাঝি কোনোদিন একেবারে নিশ্চিত হয় না। কোথাও না কোথাও কোনো না কোনোভাব নিজেদের জিইয়ে রাখে। এ হচ্ছে মৃত্যুবীজ, যা যুগ যুগ ধরে।
তিনি ১৯৫৭ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। এই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব ১৯৬০ সালের ৪ জানুয়ারি সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।