গীতিকার, গায়ক, সুরকার, চিত্রশিল্পী, লেখক এবং শান্তি কর্মীসহ ডজন খানেক বিশেষণে ভূষিত করা যাবে তাকে। তবে নিজেকে শুধু সংগীত শিল্পী হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন তিনি।
মায়ের সাথে জন লেনন। ছবি: সংগৃহীত
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার মাঝে জন্ম হয়েছিল তার। পরে গান গেয়ে সারা পৃথিবীর মানুষকে মাতোয়ারা করে শান্তির পক্ষে আর যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়েছেন তিনি। অমর সংগীত শিল্পী জন উইন্সটন ওনো লেনন তার নাম। তবে সঙ্গীতপ্রেমী মানুষজনের কাছে তিনি জন লেনন নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত।
ব্রিটিশ গায়ক জন লেনন ছিলেন ষাটের দশকে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্যান্ড দ্য বিটলসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। লেনন ও পল ম্যাককার্টনি যৌথভাবে বিটলস ও অন্যদের জন্য গান লিখতেন। এসব গান বাণিজ্যিক ভাবেও বেশ সফল ছিল। বিটলস ও জন লেনন একে অপরের পরিপূরক। লেনন মানেই একটা যুগ, সংগীতের এক নতুন পৃথিবী। সঙ্গীতের সব আগল ভেঙে নতুন ভাব ও ঢং সৃষ্টি করেছেন পঁচিশ বছরের এক যুবক।
১৯৬৫ সালের ১২ জুন। তখনও লেননের বয়স পুরোপুরি পঁচিশ হয়নি। ব্রিটেনের মহারানীর তরফ থেকে বিটলসের সদস্যদের দেওয়া হয় এমবিই মেডেল। তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দেওয়ার প্রতিবাদে চার বছর পর ওই মেডেল মহারানীকে ফিরিয়ে দিয়ে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় জনগণের কাছে হয়েছেন তুমুল জনপ্রিয়। শুধু তাই নয়, রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানান লেনন। এই প্রতিবাদ চরিত্র আজীবন ছিল লেননের মধ্যে।
ব্রিটিশ আধিপত্যের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের আন্দোলনে তিনি জোরালো সমর্থন করেন। ১৯৭২ সালে আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার দাবিতে চালানো আন্দোলনে গুলি চালায় ব্রিটিশ সরকার। ওই গুলি চালানোর সেই রক্তাক্ত সানডে (রবিবার) লেননকে বেশ আলোড়িত করেছিল। তিনি প্রতিবাদ জানাতে স্ত্রী ইওকো ওনোকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন আয়ারল্যান্ডে। লাল টি-শার্ট পরা লেননের উঁচু হাতে ধরা ছিল একটি প্ল্যাকার্ড যেখানে লেখা ছিল, ‘আয়ারল্যান্ডের জন্য, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে।’
প্রথম স্ত্রীর সাথে জন লেনন। ছবি: সংগৃহীত
সত্তরের দশক ছিল যেনে জন লেননের এক কর্মমুখর সময়। নিজের সলো অ্যালবাম, সাম্রাজ্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া, ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সব জায়গায় ছিলো তার বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। তার প্রথম সলো অ্যালবাম ‘John Lennon/Plastic Ono Band’ এর একটি গান ছিল ‘ইমাজিন’। এই গানটি বিখ্যাত রোলিং স্টোন ম্যাগাজিন পত্রিকায় সর্বকালের সেরা গানের স্বীকৃতি পায়।
জন লেনন এক প্রতিবাদী কণ্ঠের নাম। তার গিটারের ঝংকারে ধ্বনিত হয় নির্যাতীত মানুষের তীব্র প্রতিবাদ আর অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের জয়গান। তাইতো তিনি গেয়েছেন গিভ পিস আ চান্স’, ‘ইমাজিন’ বা ‘পাওয়ার টু দা পিপল’ এর মতো গান। যেখানেই যুদ্ধ, দাঙ্গা, বর্ণবিদ্বেষ সেখানেই প্রতিবাদ করেছেন লেনন। প্রতিবাদী তরুণদের তিনিই তখন মুখপাত্র।
শৈশব থেকেই আঁকাআঁকিতে জন লেননের ঝোঁক ছিল। তার চিত্রাঙ্কন দেখে স্কুলের শিক্ষকরাও মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতেন। আর তাই সতেরো বছর বয়সে লিভারপুল আর্ট কলেজে ভর্তি হতে দু’বার চিন্তা করেননি জন। তবে যার রক্ত মাংসে সংগীত মিশে আছে, সে কি সুর, তাল ও লয় ছাড়া থাকতে পারে?
জনপ্রিয় ব্যান্ড দ্য বিটলস সদস্যদের সঙ্গে জন লেনন। ছবি: সংগৃহীত
ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দেওয়ায় ব্রিটিশ সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন জন লেনন। আয়ারল্যান্ডের আন্দোলনে সরাসরি সমর্থন জানানোর কারণে ব্রিটিশ সরকারের কোপানলে পড়েন তিনি। ব্রিটেনে সোজাসাপ্টা কথা বলে লেনন যখন বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন তখন দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন জন লেনন।
জন লেননের ব্রিটেন ছাড়ার আরও কয়েকটি কারণ ছিল। প্রধান কারণ ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক সমাজব্যবস্থা। এ ছাড়া নিজের জাপানি স্ত্রী ওনোকে উদ্দেশ করে সে সময়কার ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলোর বর্ণবাদী আচরণও তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাতে বাধ্য করে।
অভিশপ্ত সেই রাত
১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর। গানের জগতে অভিশপ্ত এক রাত। রাত তখন এগারোটা। পয়েন্ট থার্টি এইট স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন রিভালভারটি পকেটে নিয়ে নিউ ইয়র্কে লেননের বাসার পাশে ড্রাইভওয়ের অন্ধকারে অপেক্ষা করছিল হন্তারক মার্ক চ্যাপম্যান। ড্রাইভওয়ের বুক চিরে দুটো উজ্জল আলো ক্রমশ এগিয়ে আসছে।
জন লেননের খুনী মার্ক চ্যাপম্যান যিনি আজও কারাগারে দিন কাটাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত
মার্ক চ্যাপম্যান অস্থির হয়ে উঠল। এই লিমুজিনটা সে ভালভাবেই চেনে।ডাকোটায় ঢোকার মুখে একটি পাথরের আর্চওয়ে, লিমুজিনটা তার কয়েক হাত আগেই থেমে গেল। তারপরেই গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন লেনন। মাত্র এক হাতের ব্যবধানে রক্তমাংসের সেই জীবন্ত কিংবদন্তী! “জন লেনন!” চ্যাপম্যান ফিস ফিস করে ডাকলেন। পরমুহূর্তেই নিস্তব্ধ সেই ড্রাইভওয়ে কাঁপিয়ে শোনা গেল গুলির আওয়াজ।
এই পিস্তলের গুলিতেই মৃত্যুবরণ করেন জন লেনন। ছবি: সংগৃহীত
পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে গুলি চালাচ্ছেন চ্যাম্পম্যান। একবার নয়, বারবার। রাত শেষ না হতেই দাবানলের মতো দুঃসংবাদ ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। আততায়ীর গুলিতে জন লেনন নিহত হয়েছেন।
মার্ক চ্যাপম্যানকে যখন মার্কিন পুলিশ গ্রেফতার করছিল, তখনও তার হাতে ধরা ছিল লেননের এল পি রেকর্ড। সেদিন বিকেলেই চ্যাপম্যান লেননের অটোগ্রাফ চেয়েছিলেন, লেনন তাতে সইও দিয়েছিলেন। ডেইলি মিরর বড় করে হেডলাইন ছাপালো ‘ডেথ অব আ হিরো‘। টাইম পত্রিকা লেননকে বর্ণনা করলো কবি বলে।নিয় ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে বেরোল ১০,০০০ মানুষের এক মৌন মিছিল। লন্ডনের হাউড পার্ক, ট্রাফালগার স্কোয়ার সর্বত্র বেজেছে ‘গিভ পিস আ চান্স’। বরফ ঝরা সেই শীতের রাতে টরন্টো শহরে লেননের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ৩৫,০০০ যুবক-যুবতী মোমবাতি জ্বালালেন।
এই বাড়িতেই থাকতেন সংগীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র জন লেনন। ছবি সংগৃহীত
শরীরের মৃত্যু ঘটলেও এই সঙ্গীত প্রতিভার আজও মৃত্যু ঘটেনি। পৃথিবীকে আজও জন লেনন মাতিয়ে রেখেছেন তার সুরের মূর্চ্ছনায়। কারণ জন লেনন মানেই একটা যুগ, বিটলস এর স্বর্ণযুগ। লেনন, ম্যাককার্টনি, জর্জ হ্যারিসন আর রিঙ্গো স্টার এর সেই যুগ। বিটলস এর সেই যুগ। গানের সুরে ভেসে যাওয়ার সেই দিন।
মাত্র ৪০ বছর বেঁচে ছিলেন জন লেনন। এত অল্প সময়েও তিনি রচনা করেছেন ২১৩ টি গান। এর মধ্যে ১৮৮ টি গান তার নিজের লেখা। আর সব মিলে সুর করেছেন ১৫০ টি গানে।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা বিবিসি ২০০২ সালে ১০০ শ্রেষ্ঠ ব্রিটিশের তালিকা নিয়ে একটি জরিপ চালায়। ওই জরিপে অষ্টম স্থানে থাকে জন লেননের নাম। বিখ্যাত ম্যাগাজিন রোলিং স্টোন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পঞ্চাশ জন শিল্পীর তালিকা প্রকাশ করেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত ওই তালিকায় জন লেনন ছিলেন ৩৮তম স্থানে।
জন লেননের মৃত্যুতে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাকে নিয়ে প্রচ্ছদ করেছিল ‘When the Music Died’। পৃথিবীকে আজও জন লেনন মাতিয়ে রেখেছেন তার সুরের মূর্চ্ছনায়।