তাঁকে ‘ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক’ বলা হয়ে থাকে। ছিলেন ভারতের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ‘রাজা হরিশচন্দ্র’ চলচ্চিত্রের পরিচালকও। তাঁর নামেই ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘দাদাসাহেব ফালকে’ দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি আর কেউ নন, দাদাসাহেব ফালকে। ভারত উপমহাদেশে যাঁর হাত ধরে আগমন ঘটে চলচ্চিত্র শিল্পের।
ক্যামেরার পেছনে উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রের জনক দাদাসাহেব ফালকে। সংগৃহীত ফাইল ছবি
পুরো নামে ধুন্ডীরাজ গোবিন্দ ফালকে। ১৮৭০ সালের এই দিনে (৩০ এপ্রিল) ব্রিটিশ ভারতের মুম্বাই মারাঠি শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশকে সিনেমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন দাদাসাহেব ফালকে।একারণে তাঁকে বলা হয়ে থাকে ‘দ্য ফাদার অব ইন্ডিয়ান সিনেমা’।
শিল্পকলার প্রতি ছেলেবেলা থেকেই তাঁর প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। ১৮৯০ সালে বরোদার মহারাজ শিবাজীরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন থেকে ফালকে জলরং ও তেলরং দিয়ে চিত্রাঙ্কনের উপর একটি কোর্স সম্পন্ম করেন।
১৮৯২ সালে আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিবিশনে’ তিনি গোল্ড মেডেল লাভ করেন। এতে এক অনুরাগী খুশি হয়ে তাঁকে একটি দামি ও ভালো মানের ক্যামেরা উপহার দেন। দাদাসাহেব ফালকে নাটক কোম্পানিগুলোর সংস্পর্শে এসে নাটক মঞ্চায়ন, দৃশ্যনির্মাণ, প্রযোজনা, মঞ্চাভিনয় প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন।
দাদাসাহেব ফালকের জীবনের মোড় ঘুরে যায় ১৯১১ সালে। ওই বছরের ১৪ এপ্রিল বড় ছেলে বালচন্দ্রকে নিয়ে মুম্বাইয়ের আমেরিকা ইন্ডিয়া পিকচার প্যালেসে ফরাসি পরিচালক অ্যালিস গী ব্লাশের ‘দ্য লাইফ অফ ক্রাইস্ট’ সিনেমাটি দেখেন। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ভক্তিমূলক সিনেমা দেখে তিনি হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীগুলোকে কেন্দ্র করে সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনা করেন।
চলচ্চিত্রে রাজা হরিশচন্দ্রের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা ডি ডি দাব। আর তার স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা আন্না সালুন। সংগৃহীত ফাইল ছবি
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দরকার চলচ্চিত্র নির্মাণ সংক্রান্ত কলাকৌশল শেখা। আর তাই ১৯১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ফালকে চলে যান লন্ডনে। সেখানে ‘বায়োস্কোপ সিনে-সাপ্তাহিক’ পত্রিকার সম্পাদক মি. কেপবার্নের সাথে দেখা করে লন্ডনে আসার উদ্দেশ্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণের আগ্রহের কথা জানান। কেপবার্ন প্রথমে এতে রাজি না হলেও অনেক অনুরোধ করায় তিনি তাঁকে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সেসিল হেপওয়ার্থের কাছে নিয়ে যান। হেপওয়ার্থ ফালকেকে সিনেমা স্টুডিওগুলো ঘুরিয়ে দেখান এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের কলাকৌশল শেখান।
রাজা হরিশচন্দ্র ছবিতে রাজা হরিশচন্দ্রের ছেলে রোহিতাশ্বের চরিত্রে ফালকের ছেলে বালচন্দ্র অভিনয় করেন। সংগৃহীত ফাইল ছবি
পরে হেপওয়ার্থ ও কেপবার্নের পরামর্শে ফালকে পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়ে একটি উইলিয়ামসনের ক্যামেরা এবং কোডাকের ফিল্ম ও পারফোরেটর ক্রয় করেন। দুই মাস লন্ডনে থেকে সিনেমা নির্মাণের বিভিন্ন কলাকৌশল শিখে ১ এপ্রিল ভারতে ফিরে আসেন এবং একইদিনে নিজের নামে ‘ফালকে ফিল্মস কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ছবি পরিচালনার জন্য শিল্পী ও কলাকুশলী দরকার। ওই সময় সাধারণত ‘ভদ্র’ ঘরের মেয়েদের চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেওয়া হতো না। এমতাবস্থায় নায়ক-নায়িকা চরিত্রে পুরুষদেরই নেওয়া হতো।
১৯১৩ সালে ফালকে রাজা হরিশচন্দ্র লেখেন, প্রযোজনা এবং পরিচালনা করেন ভারতের প্রথম কাহিনিচিত্র রাজা হরিশচন্দ্র। চলচ্চিত্রে রাজা হরিশচন্দ্রের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অভিনেতা ডি ডি দাব। আর তার স্ত্রী তারামতির চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা আন্না সালুন। রাজা হরিশচন্দ্রের ছেলে রোহিতাশ্বের চরিত্রে ফালকের ছেলে বালচন্দ্র অভিনয় করেন।
ছবিটি নির্মাণে শ্যুটিং করতে সময় লেগেছিল ছয় মাস। ৩ হাজার ৭০০ ফুট দৈর্ঘ্যের চার রিলে ছবিটি ছিল প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য নির্বাক সিনেমা। ব্যাপক বাণিজ্যসফলতার মুখ দেখার পর পরবর্তী ১৯ বছরে তিনি আরও ৯৫টি ছবি ও ২৬টি শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করেন।
রাজা হরিশচন্দ্র দিয়েই ভারতের চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রা শুরু। ১৯৩২ সালে মুক্তি পায় দাদাসাহেব ফালকে পরিচালিত শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত নির্বাক ছবি ‘সেতুবন্ধন’। আর ১৯৩৬-৩৮ সালের মধ্যে তাঁর প্রযোজিত শেষ ছবি ‘গঙ্গাবতরম’।
তাঁর অমর সৃষ্টিগুলোর মধ্যে সেরা সিনেমাগুলো হলো-মোহিনী ভাসমাসুর, সত্যবান সাবিত্রী, লঙ্কা দহন, শ্রীকৃষ্ণ জন্ম, কালিয়া মর্দন ইত্যাদি। এরপরই তিনি পুরোপুরি অবসরে চলে যান এবং ১৯৪৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নাসিকে মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৬৯ সাল থেকে ভারত সরকার তাঁর স্মৃতিতে ভারতীয় সিনেমার বহু মূল্যবান ও সম্মাননীয় ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা করে।