বাংলাসাহিত্যের এক একজন শক্তিমান লেখকের নাম প্রমথ চৌধুরী। তিনি বাংলাসাহিত্যে চলিত গদ্যরীতির প্রবর্তক। তিনি বাংলাসাহিত্যের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়ে নতুনত্ব এনেছিলেন। তার সাহিত্য রচনার সুনিপুণতা, সৃষ্টিশৈলিতা, গাম্ভীর্যতা, যুক্তিনিষ্ঠতা সাহিত্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। আজ এই সব্যসাচী প্রাবন্ধিকের ১৫৩ তম জন্মবার্ষিকী।
প্রমথ চৌধুরীকে বাংলাসাহিত্যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি প্রবন্ধ রচনা ও সাহিত্য সমালোচনার পাশাপাশি কবিতা, গল্প, চুটকি রচনায় খুব পারদর্শী ছিলেন। ব্যঙ্গাত্মক রচনাতেও তার জুড়ি নেই এবং তার কবিতাগুলো ছিল খুবই বাস্তববাদী এবং রূঢ়। প্রমথ চৌধুরীর রচনায় ছোটগল্পগুলো ছিল অসাধারণ। ছোট গল্প লেখার ক্ষেত্রে তিনি বাস্তবতার নিরিখে সুগভীর উপলব্ধি হতে সহজ সাবলীল ভাষায় লিখতেন। যেন সাধারণ পাঠক লেখাটি পড়তে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এই ধাঁচটি পরবর্তী সময়ে তার প্রবন্ধগুলোতেও দেখতে পাওয়া যায়।
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
প্রমথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালের ৭ আগস্ট যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল বর্তমান বাংলাদেশের পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর গ্রামে।
প্রমথ চৌধুরীর শিক্ষাজীবন ছিল অসাধারণ কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুল থেকে এন্ট্রাস ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এফ এ পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৮৯খ্রি বিএ(অনার্স)দর্শন, ১৮৯০সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণীতে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন এবং পরে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য বিলাত যান। বিলাত থেকে ফিরে এসে ব্যারিস্টারি পেশায় যোগদান না করে তিনি কিছুকাল ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন এবং পরে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন।
কর্মজীবন
প্রমথ চৌধুরী কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা করেন । কিছুকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কলেজে পড়ান। তিনি ঠাকুর এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। এছাড়াও তিনি মাসিক সবুজপত্র ও বিশ্বভারতী সম্পাদনা করেন। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা ইন্দিরা দেবীর সাথে তার বিয়ে হয়।
বাংলা সাহিত্যের বীরবল
সাহিত্য অঙ্গনে প্রমথ চৌধুরীর ছদ্মনাম ছিল 'বীরবল'। এ ছদ্মনামে পত্রিকার পাতায় লেখালেখি করে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তাই উনাকে বলা হতো বাংলাসাহিত্যের বীরবল। সম্রাট আকবরের দরবারে নবরেত্নর একজন ছিলেন বীরবল আর বাংলাসাহিত্যে প্রমথ চৌধুরীও তেমনি এক রত্ন। তারই নেতৃত্বে বাংলা সাহিত্যে নতুন গদ্যধারা সূচিত হয়। তিনি বাংলা সাহিত্যে ইতালিয় সনেট এর প্রবর্তক।
সম্পাদনা
প্রমথ চৌধুরী সেই সময়কার জনপ্রিয় 'সবুজপত্র' পত্রিকার একজন স্বনামধন্য সম্পাদক ছিলেন। 'সবুজপত্র' পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব বেশ সফলভাবে পালন করেন। তার 'সবুজপত্র' পত্রিকার মাধ্যমে তিনি নব্য লেখকদের একটি শক্তিশালী সংঘ তৈরি করেছিলেন। এ পত্রিকার মাধ্যমে সাহিত্যের বিকাশে তিনি ব্যাপকভাবে অবদান রাখেন এবং তরুণ প্রজন্মের লেখক ও পাঠকদের কাছে খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি বিশ্বভারতীর মতো পত্রিকার সম্পাদনাও করে গেছেন।
রচনাসমগ্র
প্রবন্ধ গ্রন্থ
জয়দেব, তেল-নুন-লকড়ী, বীরবলের হালখাতা, নানাকথা, আমাদের শিক্ষা, রায়তের কথা, নানাচর্চা, প্রবন্ধ সংগ্রহ।
গল্পগ্রন্থ
চার-ইয়ারী কথা, আহুতি, নীললোহিত, অনুকথা সপ্তক, ঘোষালে ত্রিকথা।
কাব্যগ্রন্থ
সনেট পঞ্চাশৎ, পদচারণ।
পুরষ্কার
তিনি ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'জগত্তারিণী পদক' লাভ করেন ।
মৃত্যু
১৯৪৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর ৭৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রমথ চৌধুরী মূলত সাধারণ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে সাহিত্য রচনা করতেন। পাঠকের মনোভাব উপলব্ধি করে তাদের অব্যক্ত কথাগুলো তিনি তার ছোট গল্প ও প্রবন্ধে লিখেছেন। তাই তো তিনি বলেছিলেন, 'ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ থেকে মানুষের মুখে নয়।'
তিনি রবীন্দ্র যুগে নিজেকে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং প্রশংসিত হয়েছেন।